ইতিহাসের সেরা অঘটন ঘটিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত
![ইতিহাসের সেরা অঘটন ঘটিয়ে চ্যাম্পিয়ন ভারত](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019April/1983-wc-20190518203254.jpg)
দুটি বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। ১৯৭৫ সালের পর ১৯৭৯ সালেও চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ। চার বছর বিরতি দিয়ে ১৯৮৩ সালে আবারও মাঠে গড়ালো বিশ্বকাপের তৃতীয় আসর। এবারও কাগজে-কলমে শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বরং, বলা চলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখন যে শক্তি, তাতে তাদের সামনে দাঁড়ানোর মত সাহসও যেন কারো ছিল না।
কিন্তু কি আশ্চর্য, সেই পরাক্রমশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকেই কি না ফাইনালে হারিয়ে বসলো পুঁচকে ভারত! ক্রিকেটের ইতিহাসে অন্যতম সেরা অঘটন বলা হয় ফাইনালে ভারতের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হারানোর সেই ঘটনাকে। সে সঙ্গে ক্যারিবীয়দের বাইরে প্রথমবারেরমত কপিল দেবের নেতৃত্বে প্রথম ভারত জিতে বিশ্বকাপের শিরোপা।
টানা তৃতীয়বারেরমত বিশ্বকাপের স্পন্সর প্রুডেনশিয়াল বীমা কোম্পানি। যে কারণে বিশ্বকাপের নামকরণও প্রুডেনশিয়াল বিশ্বকাপ। এবারও অংশগ্রহণকারী দলের সংখ্যা ৮টি। তবে ম্যাচের সংখ্যা বেড়েছে এবার। ১৫ ম্যাচের জায়গায় হয়েছে ২৭ ম্যাচ। এর কারণও আছে। গ্রুপ পর্বে প্রতিটি দল পরস্পর দু’বার করে মুখোমুখি হয়েছে। যে কারণে প্রতিটি দলের ৩ ম্যাচের পরিবর্তে খেলতে হয়েছে ৬টি করে ম্যাচ।
১৯৮৩ বিশ্বকাপের শুরু থেকেই তুমুলভাবে জমে ওঠে নাটকীয়তা। ক্যারি পেকার ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজের পর ওয়ানডে ক্রিকেটের নব উদ্যমে যাত্রা শুরু বলা যায় ১৯৮৩ বিশ্বকাপ। তবে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, এই বিশ্বকাপের শুরুতে ঘটে যাওয়া নাটকীয়তা।
একে নাটকীয়তা বললে কম বলা হয়। ‘বি’ গ্রুপের প্রথম দুই ম্যাচেই দুই টপ ফেবারিট অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দিলো যথাক্রমে দুই আউট সাইডার জিম্বাবুয়ে এবং ভারত। ১৯৮৩ বিশ্বকাপের নাটকীয়তার এই শুরু। একেবারে শেষ ম্যাচ পর্যন্ত এই ‘অঘটনপর্ব’ চলেছে।
ইংল্যান্ডে টানা তৃতীয়বারের মতো আয়োজিত এই বিশ্বকাপে ফরম্যাট ও আইন কানুনে বেশ নতুনত্ব যোগ করা হয়। এই বিশ্বকাপে গ্রুপপর্বে ম্যাচের সংখ্যা বাড়িয়ে করা হয় ডাবল। সে সঙ্গে অন্তত একটি ভেন্যুতে ৩০ গজ সার্কেল চালু করা হলো। পুরো ম্যাচজুড়ে কমপক্ষে চারজন করে ফিল্ডার ৩০ গজ বৃত্তের বাইরে রাখার নিয়ম প্রচলন করা হলো।
এই বিশ্বকাপে এসে আম্পায়ারদের ক্ষমতা দেয়া হলো ওয়াইড এবং বাউন্সারের ব্যাপারে আরও কঠোর হতে। যার ফলে ১৯৭৯ বিশ্বকাপের তুলনায় নো এবং ওয়াইডের পরিমাণও বেড়ে গেলো অনেক। প্রায় দ্বিগুণ (১৯৭৯ সালে ম্যাচপ্রতি ৪.৬৪; ১৯৮৩ সালে ৯.৫৯)। তৃতীয় বিশ্বকাপে এসে প্রথমবারের মতো ম্যাচ আয়োজন করার জন্য ব্যবহার করা হয় এমন কয়েকটি মাঠ, যেখানে আগে কখনো টেস্ট ম্যাচ হয়নি।
খেলা শুরু হতেই আবিষ্কার হল, চমকের পর্বটা আসলে খেলার মাঠেই অপেক্ষা করছে। জিম্বাবুয়ে সেবার প্রথমবারেরমত এসেছে বিশ্বকাপ খেলতে। এসেই চমক দেখিয়ে দিলো তারা। প্রথম ম্যাচেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানোর ভেতর দিয়ে দলটির অনেকটা বিদায় ঘন্টা বাজিয়ে দিলো জিম্বাবুয়ে। শেষ পর্যন্ত প্রথম পর্বই পার হতে পারলো না অস্ট্রেলিয়া।
শুধু কি জিম্বাবুয়ে? ভারতও তো শুরুতে চমক লাগিয়ে দিলো টপ ফেবারিট ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ২৬২ রান করে ভারত। জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২২৮ রানে অলআউট। ফলে ৩৪ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে ভারতের শুরু।
গ্রুপ পর্বে আরও একটি চমকের ম্যাচ উপহার দিয়েছে জিম্বাবুয়ে আর ভারত। ওই ম্যাচটি ছিল বলতে গেলে ভারতের জন্য জীবনমরণ ম্যাচ। টস জিতে ব্যাট করতে নেমে ১৭ রানেই ৫ উইকেট হারিয়ে বসে ভারত। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাট হাতে ঘুরে দাঁড়ান অধিনায়ক কপিল দেব।
তার ব্যাটে অবিশ্বাস্য ১৭৫ রানের এক ইনিংসই ভারতকে টেনে তুললো। ১৩৮ বলে খেলা এই ইনিংসটি কপিল সাজিয়েছিলেন ১৬টি বাউন্ডারি আর ৬টি ছক্কায়। শেষ পর্যন্ত ভারতের ৬ উইকেটে করা ২৬৬ রানের জবাবে জিম্বাবুয়ে অলআউট ২৩৫ রানে। ভারত জিতলো ৩১ রানে। এবং দ্বিতীয় দল হিসেবে উঠলো সেমিফাইনালে।
‘এ’ গ্রুপের ম্যাচে অঘটন বলতে ছিল টেস্ট পরিবারের নতুন সদস্য শ্রীলঙ্কার নিউ জিল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়া। ওদিকে নিজেদের ছয় ম্যাচের মধ্যে নিউজিল্যান্ডের কাছে কেবল এক ম্যাচে হারে ইংল্যান্ড। পাঁচ জয় নিয়ে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমি-ফাইনালে উঠতে তাদের সমস্যা হয়নি।
ইংলিশদের সঙ্গী হওয়ার লড়াইটা ছিল জম্পেশ। পাকিস্তান ও নিউ জিল্যান্ড দুই দলই জেতে তিনটি করে ম্যাচ। রান রেটে নিউ জিল্যান্ডের (৩.৯২৭) চেয়ে সামান্য এগিয়ে পাকিস্তান (৪.০১৪) পেয়ে যায় সেমি-ফাইনালের টিকেট।
সেমিফাইনালে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ফাইনালে উঠে অন্যতম সেরা চমক সৃষ্টি করে ভারত। অন্য সেমিফাইনালে পাকিস্তানের মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এখানে আর পাকিস্তান চমক সৃষ্টি করতে পারেনি। অ্যান্ডি রবার্টস, ম্যালকম মার্শালদের আগুনে বোলিংয়ের সামনে উড়ে গেছে পাকিস্তান। মাত্র ১৮৮ রানে অলআউট হওয়ার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজ জিতেছে ৮ উইকেটের ব্যবধানে।
ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচে যে ক্যারিবীয়দের হারিয়ে চমক দেখিয়েছিল ভারত। এই ম্যাচে এসে বিশ্ব দেখলো বিশ্বকাপ ইতিহাসের তখন পর্যন্ত সবচেয়ে অকল্পনীয় ঘটনা- ওয়েস্ট ইন্ডিজ হেরে গেলো ভারতের কাছে।
গ্যালারিতে উপস্থিতি হাজার ত্রিশেক দর্শকের মধ্যে ভারতীয়দের সংখ্যা কম ছিল না; কিন্তু শিরোপা জেতার আশা তারাও খুব একটা করেনি। আর অ্যান্ডি রবার্টস, জোয়েল গার্নার, ম্যালকম মার্শাল, মাইকেল হোল্ডিংয়ের আগুনে পেস বোলিংয়ের সামনে ভারত ১৮৩ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর তো আরো না। গ্যালারিতে তখন ক্যালিপসোর সুর মুর্ছনায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ সমর্থকরা মাতোয়ারা। টানা তৃতীয়বারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটা ছিল যেন কেবলই সময়ের ব্যাপার!
গড়পড়তা ব্যাটিং শেষে ভারতীয় ড্রেসিংরুমে পিনপতন নীরবতা। এত কাছে এসেও ট্রফি জিততে না পারায় আগাম বেদনা খেলোয়াড়দের চোখে-মুখে। এমন সময় দলকে নিয়ে ফিল্ডিংয়ে যাওয়ার আগে অধিনায়ক কপিল দেব দিলেন সেই অমর ক্রিকেটীয় বাণী, ‘ছেলেরা, আমাদের স্কোর যদি ম্যাচ জেতার মতো না-ও হয়, লড়াই করার মতো তো বটেই। এসো আমরা সেই লড়াইটাই করি।’
সেই লড়াইটাই করলো ভারত। তাতে সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী ভূমিকা ছিল অধিনায়কের। ড্রেসিংরুমে উজ্জীবনী ওই ভাষণেই শুধু নয়, ভিভ রিচার্ডসের অবিশ্বাস্য ক্যাচটি ধরেও।
ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতে গর্ডন গ্রিনিজকে হারায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর ভিভ রিচার্ডস নেমেই শুরু করেন তাণ্ডব। মাত্র ২৭ বলে ৩৩ রান করে জয়ের পথে নিয়ে যাচ্ছিলেন দলকে; কিন্তু এরপর মিডিয়াম পেসার মদনলালকে হুক করতে গিয়ে টাইমিংয়ে গড়বড় হয়ে যায়। তবু শূন্যে উঠে যাওয়া রিচার্ডসের বলটি নিরাপদেই ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ পড়বে বলে মনে হচ্ছিল; কিন্তু মিড উইকেটে প্রায় ২০ গজ পেছন দিকে দৌড়ে দুর্দান্ত এক ক্যাচ ধরে ফেলে কপিল। ম্যাচ সে সময়ই বেরিয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজের হাত থেকে।
মদনলাল-মহিন্দার অমরনাথদের মতো মিডিয়াম পেস বোলারদের সামনে আত্মাহুতির মিছিলে সামিল হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজের কালজয়ী ব্যাটিং লাইন; মাত্র ১৪০ রানে অলআউট তারা। ব্যাটিংয়ে ২৬ রান করা অমরনাথ বোলিংয়ে সাত ওভারে ১২ রান দিয়ে নেন তিন উইকেট। সেমি-ফাইনালের মতো ফাইনালেও তাই তিনি ম্যান অব দ্য ম্যাচ।
যারা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন নিয়ে মোটেও যায়নি ইংল্যান্ডে, তারাই কি না শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন! ‘আমরা ছুটির মেজাজে ভারত ছেড়েছিলাম। লন্ডন পৌঁছানোর পর ক্রিকেটের চেয়ে বাকিংহ্যাম প্যালেস, হাইড পার্ক ও ট্রাফালগার স্কয়ার দেখাও কম আকর্ষণীয় ছিল না’- ভারতীয় দলের সন্দীপ পাতিলের কথায় ছিল এর বড় প্রমাণ।
অথচ কী আশ্চর্য, লন্ডন দেখতে যাওয়া সেই ভারতীয় দলটিই কিনা মাথায় চ্যাম্পিয়নের ট্রফি নিয়ে ফিরে এলা দেশে।
আইএইচএস/এমএস