‘শৈশবের ভুল শিক্ষার মাধ্যমেই শুরু হয় কালোদের প্রতি ঘৃণা’
![‘শৈশবের ভুল শিক্ষার মাধ্যমেই শুরু হয় কালোদের প্রতি ঘৃণা’](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/holding-20200709103757.jpg)
বর্ণবাদী আচরণের ব্যাপারে এখন উত্তাল সারা বিশ্ব। এর ছোঁয়া লেগেছে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনেও। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকান-আমেরিকা জর্জ ফ্লয়েড হত্যার ব্যাপারে সরব ফুটবল, ক্রিকেটসহ প্রায় সব খেলার ক্রীড়াবিদরা। সবাই এক বাক্যে সমর্থন দিচ্ছেন বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনে। একাত্মতা প্রকাশ করছেন ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ স্লোগানের সঙ্গে।
এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা করেছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কিংবদন্তি পেসার মাইকেল হোল্ডিং। স্কাই স্পোর্টসের সঙ্গে আলোচনায় তিনি তুলে ধরেছেন সমাজের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটি, জানিয়েছেন কীভাবে একদম ছোটবেলা থেকেই একজন শিশুর মনে ঢেলে দেয়া হয় বর্ণ বৈষম্যের বিষ।
বুধবার থেকে শুরু হয়েছে ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার টেস্ট সিরিজ। বর্ণ বৈষম্যের ব্যাপারে রুখে দাঁড়ানোর জন্য দুই দলের জার্সিতেই রয়েছে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার লোগো’। বৃষ্টির কারণে প্রথম দিন খেলা হয়েছে মাত্র ১৭.৪ ওভার। ফলে আলোচনার সুযোগ ছিল অনেক।
যেখানে স্কাই স্পোর্টসের এবোনি রেইনফোর্ড ব্রেন্টের সঙ্গে হোল্ডিংয়ের শিক্ষামূলক আলোচনার পুরোটাই তুলে ধরা হলো জাগোনিউজের পাঠকদের জন্যঃ
‘আমি শিক্ষার কথা বলি, ইতিহাসের শুরুর দিককার সময়ের...মানুষের বোঝা উচিৎ, এ বিষয়টা (বর্ণবাদী আচরণ) অনেক অনেক বছর আগে থেকেই চলে আসছে। কৃষ্ণাঙ্গদের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি না দেয়ার মাধ্যমেই সবকিছুর শুরু। এখনের মানুষ হয়তো বলবে, এগুলো অনেক অনেক আগের কথা। কিন্তু না! আপনি সহজেই এগুলোকে বাদ দিতে পারবেন না।’
‘এসবের ছায়ায় সমাজ এখন আরও বেশি বিষাক্ত। যখন ছোট ছিলাম, ব্রেইনওয়াশের অর্থ বুঝতাম না। এখন আমি বুঝি মানুষ, সাদা মানুষ, কালো মানুষ- এভাবে অনেক আগে থেকেই নানান উপায়ে ব্রেইনওয়াশ করা হয়।’
‘আপনি ধর্মের কথাই চিন্তা করুন। যীশু খ্রিস্টের চামড়া দেখানো হয় সাদা বর্ণের, চোখ নীল এবং চুলগুলো সোনালী। কিন্তু যেখানে যীশুর জন্ম (জেরুজালেম), সেখানের কোন মানুষটা আসলে এমন হয়? তাদের গায়ের রঙ তো এমন হয় না। ঠিক এভাবেই পরিপূর্ণ মানুষের উদাহরণ হিসেবে ভুল তথ্য দেখিয়ে ব্রেইনওয়াশ করা হয়। তখনকার গল্পের ভিত্তিতে করা নাটকের কথাই ধরুন, জুডাস; যে কি না যীশুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাকে দেখানো হয় একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে। এটাই তো ব্রেইনওয়াশ। মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়, কালো মানুষ মানেই খারাপ মানুষ।’
‘আপনি ইতিহাসে ফিরে যান। থমাস এডিসন বাল্ব আবিষ্কার করেছেন সবাই জানি। কিন্তু সে লাইট বাল্বটি আবিষ্কার করেছিল পেপার ফিলামেন্ট দিয়ে। যা দ্রুতই পুড়ে যেত। আপনি কি বলতে পারবেন, এই বাল্বগুলোকে দীর্ঘক্ষণ জ্বালানোর উপযোগী করেছিল কে? কেউ বলতে পারবে না। কারণ বিদ্যালয়ে এটা শেখানোই হয় না। বাল্বগুলোকে উজ্জ্বল আলো দেয়ার জন্য কার্বন ফিলামেন্ট বানিয়েছিলেন লুইস হাওয়ার ল্যাটিমার, একজন কৃষ্ণাঙ্গ। কয়জন জানেন এটা?’
‘সবকিছুই শেখানো উচিৎ, কোনকিছু বাদ দিয়ে নয়। আমার শৈশবে স্কুলে কখনও কালো মানুষদের ব্যাপারে ভালো কিছু শিখিনি। আপনি সমাজকে এমনভাবে এগিয়ে নিতে পারবেন না, যা কি না শুধুমাত্র শিক্ষকদের জন্য সুবিধাজনক। ইতিহাস সবসময় জয়ীদের পক্ষে লেখা হয়, বিজিতের পক্ষে নয়। ইতিহাস তারাই লেখে, যারা আসলে শোষণ করেছে, শোষিতরা নিজেদের কথা লিখতে পারে না। আমাদের উচিৎ ইতিহাসে ফিরে মুদ্রার দুই পিঠের ব্যাপারেই যথাযথ শিক্ষাগ্রহণ করা।’
‘আমরা যতদিন পর্যন্ত এটি না করছি এবং সব মানুষকে একইভাবে শিক্ষা না দিচ্ছি, বর্ণবৈষম্য বন্ধ হবে না। আমাদের এখন আবার শিখতে হবে এবং শেখাতে হবে। কেননা এখন যেকোন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ এটাই মনে করে যে, তারা অন্যান্য মানুষের চেয়ে কম যোগ্য। কিন্তু এমনটা হওয়া তো সঠিক নয়।’
‘মানুষ বলে যে, সাদাদের জন্য বাড়তি কোন সুবিধা নেই কোথাও। আপনারা থামুন। আপনি কখনও দেখিনি একজন সাদা চামড়ার মানুষ অক্সফোর্ড স্ট্রিটের কোন দোকানে যাওয়ার পর কেউ তার পিছু নিয়েছে। কিন্তু কালো মানুষ যেখানেই যাবে, তার পেছনে কেউ না কেউ লাগবে। এটাই সাদা হওয়ার বাড়তি সুবিধা।’
‘আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই যে, আমি মনে করি না সব সাদা মানুষেরাই বর্ণবাদী এবং বর্ণবৈষম্যের কথা ভাবে। বিষয়টা এমন নয় যে, আমি কালো বলে সাদাদের পছন্দ করব না কিংবা আমি সাদা বলে কালোদের মূল্য দেবো না।’
‘২০১৬ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা গবেষণা করা হয়। যেখানে ১৩০ জন প্রি-স্কুল শিক্ষকদের একটা ঘরের মধ্যে রেখে ভিডিও ছেড়ে দিয়ে বলা হয় খারাপ ব্যবহার খুঁজে বের করতে। সেই ভিডিওতে কালো ছেলে, সাদা ছেলে, কালো মেয়ে এবং সাদা ছেলে ছিলো। মজার বিষয় হলো, ভিডিওতে আসলে কোন খারাপ ব্যবহারই ছিল না। কিন্তু শিক্ষকদের চোখে লাগানো ট্র্যাকার দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে যে, তারা পুরো ভিডিওতে কালো ছেলে-মেয়েদের দিকেই তাকিয়ে ছিল (খারাপ ব্যবহার খোঁজার জন্য)।’
‘একজন শুধুমাত্র চায়নি যে এই গবেষণার ফল প্রকাশিত হোক। বাকি ১২৯ জন শিক্ষক লজ্জিত বোধ করছিল। তারা নিজেরাও জানত না, নিজেদের অবচেতন মনেই করেছিল এমন (খারাপ ব্যবহার খুঁজে কালোদের দিকে তাকিয়ে থাকা)। আমরা যে সমাজে বড় হই, এটা অনেকটা ওসমোসিস প্রক্রিয়ার মতো। যা আপনার অবচেতনেই মনের মধ্যে জায়গা করে নেয়।’
‘একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ সালে আরেকটি গবেষণা করা হয় পুলিশ অফিসারদের নিয়ে। তাদের সাদা ও কালো কিশোর-কিশোরীদের কিছু ছবি দেখানো হয় এবং প্রত্যেক পুলিশ অফিসারকে সেই কিশোর-কিশোরীদের বয়স সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। গড়পড়তা প্রায় সব পুলিশ অফিসার কালো ছেলে-মেয়েদের বেলায় সত্যিকারের বয়সের চেয়ে সাড়ে চার বছর বেশি লিখেছিল কিন্তু সাদা ছেলে-মেয়েদের বয়স খুব সহজেই সঠিকটা বলতে পেরেছিল।’
‘একজন পুলিশ অফিসার হিসেবে আপনি যখন ১৪ বছরের কারও বিচার করতে গিয়ে, মনের মধ্যে ১৮-১৯ বছর ভাববেন, তখন আপনার আচার-আচরণও বদলে যাবে। তখন আর সে আপনার চোখে ১৪ বছরের নিষ্পাপ কিশোর থাকবে না, প্রাপ্তবয়ষ্ক মনে হবে। ফলে আপনার অ্যাপ্রোচও হবে ভিন্ন। এ জিনিসগুলোই বদলানো উচিৎ।’
‘আমরা জানি, পুলিশ অফিসাররা প্রায়ই কালো মানুষদের নানানভাবে হেনস্থা করে। শুধু ইংল্যান্ড বা যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সারা বিশ্বেই এমনটা হয়ে থাকে। সমাজব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন না আনলে, এই সমস্যার কোন সমাধান নেই।’
এসএএস/পিআর