এআই ধাক্কায় টিকে থাকার লড়াইয়ে স্বল্প বেতনের চাকরিজীবীরা

স্টাইটেক সলিউশনস নামে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের একটি প্রকল্পে কাজ করতেন শাহরিয়ার শুভ। তিনি উবার ফ্রেইট পরিষেবার চালান তৈরি করতেন। পরে সেটি কাস্টমার রিলেশনশিপ ম্যানেজমেন্ট নামে একটি সিস্টেমে আপলোড করতেন। এ কাজে কখনো কখনো ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রায় সাড়ে আট ডলার আয়ও করেছেন তিনি। চাকরি ও আয়-রোজগার নিয়ে শুভ আত্মবিশ্বাসী ছিলেন।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ধাক্কায় তিনি চাকরি খুইয়েছেন। শুধু শুভ নন, তার সঙ্গে কাজ করা ৮০ শতাংশ কর্মীকে ছাঁটাই করেছে স্কাইটেক সলিউশনস। যে প্রকল্পে শুভ কাজ করতেন, তাতে ৫৫ জনের পরিবর্তে এখন কর্মীর সংখ্যা মাত্র নয়জনে নামিয়ে এনেছে প্রতিষ্ঠানটি।
শাহরিয়ার শুভ বলেন, ‘গত বছরের শেষ দিকে চাকরি হারিয়েছি। ভাবতেও পারিনি এআইর কারণে চাকরি হারাতে হবে। বিকল্প চাকরির চিন্তাও করতাম না। ফলে হঠাৎ চাকরি হারিয়ে বিপাকে পড়েছিলাম। বাধ্য হয়ে ঈদের আগে একটি ব্র্যান্ডের শোরুমে মাত্র ১৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি নিয়েছি।’
আরও পড়ুন
- ‘এআই রিপ্লাইজ’ আপনার হয়ে ফোন রিসিভ করবে এআই
- ঘিবলি স্টাইলের এআই ছবি বানাবেন যেভাবে
- ব্যক্তিগত তথ্য এআইকে শেয়ার করলেই বিপদে পড়তে পারেন
- যে পেশায় মানুষের জায়গা নিতে পারবে না এআই
স্কাইটেকের প্রতিষ্ঠাতা মুসনাদ-ই-আহমেদ বলেন, ‘যে প্রকল্প থেকে লোক ছাঁটাই করেছি, সেটা যারা করাচ্ছেন; তারা আমাদের বলেছেন প্রাথমিক কাজটি এখন এআই অটোমেশনের মাধ্যমে করা হবে। কর্মীরা শুধু মাননিয়ন্ত্রণ করবেন। মাননিয়ন্ত্রণের কাজে যে কয়জন প্রয়োজন, তাদের রেখে বাকিদের ছাঁটাই করতে বাধ্য হয়েছি আমরা।’
স্টাইটেক সলিউশনসের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ধাক্কায় বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্মী ছাঁটাই করতে বাধ্য হচ্ছে। চাকরি হারাচ্ছেন বহু পেশাজীবী। বাংলাদেশেও সেই প্রভাব পড়ছে। দেশে চাকরিতে এন্ট্রি লেভেল ও কম বেতনে কাজ করা চাকরিজীবীরা বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। স্বল্প শিক্ষিত ও মোটামুটি প্রশিক্ষিত কর্মীদের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে আইটি পেশার অনেকে চাকরি হারালেও দৃশ্যমান হচ্ছে না। আগামী দুই-তিন বছরের মধ্যে ক্রমে বড় হারে চাকরি হারানোর বিষয়টি দৃশ্যমান হবে। হয়তো প্রতিষ্ঠানে নিজের বিকল্প কেউ নেই ভাবা ব্যক্তিও তখন চাকরি হারানোর বড় ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
বেশি ঝুঁকিতে যেসব চাকরিজীবী
বাংলাদেশে এআই ব্যবহারে চাকরি হারানোর ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। ই-কমার্স, আইটি সাপোর্ট, কাস্টমার সার্ভিস প্রোভাইড করা প্রতিষ্ঠানগুলোতে এন্ট্রি লেভেলের চাকরি শূন্যের কোটায় নামছে। বিশেষ করে যেসব কাজ বারবার করা হয়, সেসব কাজ-সংশ্লিষ্ট পদে মানবসম্পদ না রেখে এআই দিয়ে করানোর দিকে ঝুঁকছে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
আরও পড়ুন
- মানুষের মৃত্যুর দিনক্ষণ সত্যিই কি জানাতে পারে এআই?
- এআই ভয়েস ক্লোনিং বুঝবেন ৪ সংকেতে
- ডিপসিক কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ এআই অ্যাপ হয়ে উঠলো?
- বিশ্বের দ্রুততম এআই সুপার কম্পিউটার আনছে মেটা
তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে বহুসংখ্যক জনবল নিয়োগ দেয়। সরকারি চাকরিতে এ ধরনের পদ অগণিত। বেসরকারিতেও কম নয়। এআই’র ধাক্কায় সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে ডাটা এন্ট্রি অপারেটররা।
স্কাইটেকের প্রতিষ্ঠাতা মুসনাদ-ই-আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আগে আমরা যেসব কাজ ভয়েস সার্ভিসের মাধ্যমে করতাম, বিশ্বব্যাপী এখন সেসব কাজ এআইয়ের মাধ্যমে হচ্ছে। গ্রাহক সহায়তা, সেবা বিক্রি ও বিপণন পরিষেবাসহ উল্লেখযোগ্য কাজ এআই করে দিচ্ছে। এন্ট্রি লেভেলের কাজগুলো বিশেষ করে ভয়েস পরিষেবা এখন এআই’র দখলে। এআই-বিপ্লবে গত দেড় বছরে ৩০ শতাংশ এন্ট্রি লেভেলের কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।’
এদিকে, ই-কমার্সের প্রসারের ফলে কাস্টমার সার্ভিস প্রতিনিধি পদে অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে। সেখানেও বড় ধাক্কা দিচ্ছে এআই। টেলিমার্কেটিং ও বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে চাকরিও বিলুপ্ত হতে পারে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এমনকি গণমাধ্যমেও অনুবাদক পদে বিপুলসংখ্যক মানুষ চাকরি করেন। তারাও এআই’র ধাক্কায় চাকরি খোয়াতে পারেন।
এছাড়া আইটি সাপোর্ট, কনটেন্ট রাইটার, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, হিসাবরক্ষক ও সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মানবসম্পদের চেয়ে এআই বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। এআই’র মাধ্যমে এ কাজগুলো দ্রুততম সময়ে যেমন করিয়ে নেওয়া যাচ্ছে, তেমনি নির্ভুল এবং দুর্নীতি-অনিয়মমুক্ত থাকা সম্ভব।
আরও পড়ুন
- আপনার হয়ে প্রেমপত্র লিখে দেবে এআই
- বিশ্বের প্রথম এআই সুন্দরী প্রতিযোগিতা
- এবার মেটার নতুন এআই লামা-৪ বিশ্ব কাঁপাবে
- এআই ব্যবহারে নৈতিক ও আইনি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত হতে হবে
সফটওয়্যার কোম্পানি কোডেক্সপার্টের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) নাজমুল আহসান। এআই আসার পর তার কাজের ধরন বদলে গেছে। তার সহকারী হিসেবে যারা কাজ করতেন, তাদের এখন আর প্রয়োজন হয় না।
নাজমুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার কোম্পানির মার্কেটিংয়ের জন্য প্রচুর লেখালেখি করতে হয়, যেটাকে আমরা কনটেন্ট মার্কেটিং বলি। এটা মানুষকে দিয়ে করিয়ে নিতে সময় লাগতো অনেক। আবার খরচও বেশি ছিল। এআই আসার পর অবস্থাটা এমন যে খরচ শূন্যের কোটায় নেমে গেছে। আর সময়ও খুব কম লাগে।’
নাজমুল আহসান বলেন, ‘আমাদের কোনো পণ্য কেউ কিনেছেন বা ব্যবহার করছেন, তিনি হয়তো কোনো অসুবিধায় পড়েছেন। আমাকে মেইল করে সহযোগিতা চেয়েছেন। ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বা তাকে প্রতিউত্তর দিতে লিখতে হতো। এজন্য এক-দুজন কর্মীর প্রয়োজন হতো। সেটা এখন লাগছে না। ৩০ সেকেন্ডে বিনা খরচে এআই দিয়ে করিয়ে নিচ্ছি। বড় বড় প্রতিষ্ঠান আরও বড় বড় কাজ করাচ্ছে। কেউ কেউ মাসিক ও বার্ষিক পরিকল্পনা করছেন, রিপোর্ট বানিয়ে নিচ্ছেন, যা করতে হয়তো ১০ থেকে ১২ জন লোকবলের প্রয়োজন হতো।’
প্রভাব দৃশ্যমান হবে আরও ৪-৫ বছর পর
এআই’র কারণে চাকরি হারানোর বড় প্রভাব বাংলাদেশে দৃশ্যমান হতে আরও চার থেকে পাঁচ বছর সময় লাগতে পারে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বে বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকায় প্রভাবটা বেশি বলে মনে করেন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি এবং বিডিজবসের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ফাহিম মাশরুর।
তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সামনের বছরগুলোতে এআই’র ধাক্কায় বাংলাদেশে চাকরি হারানোর বিষয়টি হয়তো খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না অথবা দৃশ্যমান হবে না। লংটার্মে (দীর্ঘমেয়াদি) এটার বড় প্রভাব আছে। হয়তো আরও চার থেকে পাঁচ বছর পর বড় আকার ধারণ করবে।’
আরও পড়ুন
- আন্তর্জাতিক এআই অলিম্পিয়াডে দুটি রৌপ্যসহ ৪ পদক জিতলো বাংলাদেশ
- ডিপসিকের চমকে এআই চিপের ব্যবসা রমরমা
- ইনস্টাগ্রামে এআই প্রোফাইল ছবি বানাতে পারবেন
তবে কিছু জায়গায় এরই মধ্যে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বলেও মনে করেন ফাহিম মাশরুর। তার ভাষ্যমতে, ‘স্বল্পপরিসরে যে প্রভাব পড়েছে, সেটা সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোতে। অনেকে বিদেশি ক্লায়েন্টের কাজ করেন, সেখানে এআই’র ব্যবহার বাড়ছে। বিদেশি ক্লায়েন্টরা কম খরচে এআই দিয়ে কাজ করানোর ওপর জোর দিচ্ছেন। তাছাড়া অন্যান্য সেক্টরে এআই’র খুব বড় প্রভাব দেখছি না।’
আশা জাগাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মুখোমুখি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর শ্রমিকরা’ শিরোনামে একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বাংলাদেশসহ ২৫টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে এআই প্রযুক্তির কারণে চাকরি হারানোর ঝুঁকির বিষয়টি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তাতে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে তুলনামূলক ঝুঁকি কম বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে অনেক পেশা এখনো ম্যানুয়াল ও আন্তঃব্যক্তিক যোগাযোগভিত্তিক। যেমন—কৃষি, পোশাক কারখানা ও সেবাখাত। এ পেশাগুলো এআই দিয়ে সহজে রিপ্লেস বা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব নয়। তবে এআই’র ব্যবহারে পুনরাবৃত্তিমূলক কাজের চাকরিজীবীরা ঝুঁকিতে পড়তে পারেন।
বাংলাদেশে এআই’র প্রভাব মোকাবিলায় দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম—দক্ষতা উন্নয়ন, প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা রপ্ত করা এবং মানসম্মত শিক্ষা ও গুণগত প্রশিক্ষণ বাড়ানো।
বিশ্বব্যাংকের এ প্রতিবেদনের সঙ্গে একমত জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন ‘আপ স্কিল’ এবং ‘ক্রিয়েট স্কিল’ বিষয়ে জোর দিয়েছেন। তিনি বলেন, আপ স্কিল মানে হলো—আপনি যতটুকু জানেন, তার থেকে বেশি শেখার চেষ্টা করতে হবে। আর ক্রিয়েট স্কিল হলো—নতুন নতুন কাজ শিখতে হবে। যেমন—কেউ গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে আছে, সেখানে চাকরি চলে গেলে অন্য কোথাও যাতে তিনি পুনর্বাসিত হতে পারেন।’
প্রস্তুতিতে অবহেলা করলেই বড় বিপর্যয়ের শঙ্কা
এআই’র প্রভাবে পশ্চিমাবিশ্বে এরই মধ্যে অস্থির হয়ে উঠেছে চাকরির বাজার। প্রতিদিন বেকার হয়ে পড়ছে লাখো মানুষ। বাংলাদেশে এখনো ধাক্কাটা দৃশ্যমান না হলেও প্রস্তুতিতে অবহেলা না করার ব্যাপারে সতর্ক করেন বিশেষজ্ঞরা।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক ড. বি এম মইনুল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এআই আসায় কিছু পেশা হারিয়ে যাচ্ছে, যাবে। আবার নতুন নতুন কিছু পেশা বা সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এখন কী করতে হবে? সেটা খুব সাধারণ কথা হলে—নতুন যে জব সেক্টর তৈরি হবে, সেটার জন্য প্রস্তুত হওয়া, দক্ষ কর্মী তৈরি করা।’
লাইফ লং লার্নিং (আজীবন শেখা) টার্মকে গুরুত্ব দিতে হবে জানিয়ে মইনুল হোসেন বলেন, ‘একটা সময়ে পড়ে এসে সারাজীবন সেটা দিয়ে কাজ করবেন, সেটা চলবে না। ছাত্রজীবনে শিখেছেন, সেটাই সম্বল; আর কিছু হাতে নেই। তাহলে সেটা টেকসই নয়। প্রতিনিয়ত শেখার মধ্যে থাকতে হবে। বয়স যার যেটাই হোক, সময় ও প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোতে হবে। প্রতিনিয়ত কিছু না কিছু শিখতে হবে।’
একই কথা বলছেন বেসিসের সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুরও। তার ভাষ্য, ‘সফটওয়্যার কোম্পানি, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সারদের যেমন এআই বেকার করে দিচ্ছে, তেমনি নতুন নতুন কাজের সম্ভাবনাও তৈরি করছে। যেগুলো এআই দিয়ে করা সম্ভব নয়। সেজন্য দক্ষ-যোগ্য এবং ডায়নামিক ম্যানপাওয়ার তৈরি করতে হবে। তাহলে নিশ্চিন্তে টিকে থাকা যাবে।’
এএএইচ/এমএমএআর/এমএফএ/জেআইএম