কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব-৮

রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৫:২৮ পিএম, ২৪ এপ্রিল ২০২৪

সাইখ আল তমাল

পরদিন সকাল ১১টায় জয়দীপদার সঙ্গে দেখা করার কথা। নিয়ত করে এসেছিলাম ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর হাওড়া ব্রিজ না দেখে আমি ফিরবো না। কিন্তু অনিকদাকে না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ি। আর এই পরিস্থিতিতে আমাকে উদ্ধার করেছে জয়দীপদা। কথা ছিল পার্কস্ট্রিটের মেট্রো স্টেশনের সামনে আমি অপেক্ষা করবো। সেখান থেকে দুজনে রওয়ানা দেব। এবার একটু বেলা করেই ঘুমোলাম। সকালবেলা হাঁটতে হাঁটতে রওয়ানা দিয়েছি। তখনো নাস্তা করা হয়নি। আশপাশে কোথাও করে নেব ভাবছি। পকেটে ক্যাশ রুপিও নেই খুব একটা। জয়দীপদা এলে তার থেকে ক্যাশ পাওয়া যাবে। আপাতত ঘুরছি, কলকাতার ট্রাফিক আর গলিগুলো দেখছি। গতরাতে যে পথ যেতে আমার অনেক ঘুরতে আর গুগল ম্যাপের সাহায্য নিতে হয়েছিল, আজ সকালে সেই পথ আমি একাই চিনে নিয়েছি। এবার বেশি ঘুরতে হয়নি। সোজা রাস্তা আবিষ্কার করেছি।

ভারী আনন্দ হচ্ছে, এখন আর পথ অচেনা ঠেকছে না। নিজেই নিজেকে বেশ তারিফ করলাম। বেলার সঙ্গে ক্ষিধেও বাড়ছে। মনে মনে নাস্তার দোকান খুঁজছি। পার্কস্ট্রিটেই কয়েকটা নাস্তার দোকান পেলাম। এর মধ্যে একটা থেকে ডাবল ডিমের রোল নিলাম। গরম গরম বানিয়ে দিলো ৬০ রুপিতে। কিন্তু অত বড় রোল আমি পুরোটা খেয়ে শেষ করতে পারিনি। কিছু অংশ ময়লার গাড়িতে ফেলে দিয়েছি। পার্কস্ট্রিটেই বসে আছি অনেকক্ষণ, জয়দীপদা আসছে না এখনো। তাকে ফোন করলাম, বললো এখনি বের হবে। আমি এত আগে চলে আসবো সে ঠাওর করতে পারেনি। হয়তো আরেকটু ঘুমোতে চেয়েছিল। অযাচিত যাতনা দিয়ে ফেললাম কি না!

মোড়েই শপিং মল ছিল। সময় কাটাতেই শপিং মলে যাওয়া। আবার কিছু কেনাকাটার নিয়তও ছিল কিন্তু সেটা ফেরার পথে। এখন কেনাকাটা করলে পুরো পথ হাতে ব্যাগ বইতে হবে। এদিকে অনেক জায়গা ঘোরা বাকি। ভিক্টোরিয়া থেকে হাওড়া অনেকটা পথ। কিছু জিনিসপত্র পছন্দ করে গেলাম। ফেরার পথে নেব ঠিক করেছি। কিন্তু পছন্দ করে রাখা একটা জামা ফেরার পথে পাইনি। কিছুটা মন খারাপের সঙ্গে আফসোসও হলো। তখন কেন নিলাম না।

রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি

অবশেষে জয়দীপদা এলো। দুজনে মিলে পার্কস্ট্রিট থেকে মেট্রোতে চড়লাম। এবারের গন্তব্য ময়দান। ময়দান নেমে যাব ভিক্টোরিয়া, অল্প হাঁটা পথ। পথে যেতেই বিখ্যাত গড়ের মাঠ। শহরের মাঝে বিশাল মাঠ, ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। অনেকটা আমাদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো। তবে এখানটায় অনেক কিছুই পরিত্যক্ত যা আমাদের এখানে নেই। এখন অবশ্য নতুন মেট্রো লাইন চালু হয়েছে কলকাতায়। ভারতের প্রথম আন্ডারওয়াটার মেট্রো চালু হলো হুগলি নদীর নিচ দিয়ে। এখন হাওড়া স্টেশনে সরাসরি মেট্রোতেই ভ্রমণ করা যাবে। আর ভিক্টোরিয়া স্টেশনও নতুন করে চালু হয়েছে। তাই আমার মতো ঝামেলা করে আর কাউকে আসতে হবে না।

পথে অনেক গল্প শুনালো জয়দীপদা। আমাদের আলোচনায় ছিল ট্রাম। ময়দান মেট্রো থেকে ইন্দিরা পার্কের সামনে আসতেই চোখে পড়লে একসময়কার ট্রামের লুপের স্মৃতিটুকু দেখতে পেলাম। একটা সময় এখানে ট্রাম এসে ভিড়তো। আজ তা শুধুই স্মৃতি বহন করে আছে। একসময়কার নিত্য প্রয়োজন আজ নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক জীবনের মতো। চলতি পথে আমরা অনেক প্রয়োজন মেটাই। একসময় তা ফুরিয়ে যায়।

ফেব্রুয়ারি মাস হলেও রোদ খুব চড়া। কলকাতায় গরমের তীব্রতা কেমন হতে পারে আন্দাজ করে নিলাম। গায়ে জ্যাকেট রাখতে পারছি না, গরম লাগা শুরু হয়েছে। কলকাতার আবহাওয়া অনেকটা বাঙালি নারীদের মতো। ক্ষণে ক্ষণে বদলায়। কখনো বৃষ্টি, কখনো কুয়াশা আবার কখনো তীব্র রোদ। ময়দান পেরিয়ে ভিক্টোরিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছি। পথ আটকে দাঁড়ালো তথাকথিত তৃতীয় লিঙ্গের কয়েকজন। ঢাকা আর কলকাতায় এই জিনিসের পুরো মিল। রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে তাদের উপস্থিতি থাকবে। জয়দীপদাই খুচরো টাকা ওদের হাতে দিয়ে বিদেয় করলো। নয়তো আবার কি কেলেঙ্কারি বাঁধাতো কে জানে।

রাস্তার ওপাশে গড়ের মাঠ দেখা যাচ্ছে। কয়েকটা হলুদ ট্যাক্সি পাশ কাটিয়ে গেল। ভিক্টোরিয়ার উল্টো পাশেই গড়ের মাঠ। পুরো জায়গাটাই মিলিটারি নিয়ন্ত্রিত। বেশ গোছানো পরিবেশ। রানির স্মৃতি এখনো ঝেরে মুছে চকচকে করে রেখেছে কর্তৃপক্ষ। টিকিট কেটে ভেতরে যেতে হবে। কতগুলো ফিরিঙ্গির দেখা পেলাম। হাফ প্যান্ট আর টি শার্ট পরা সাদা চামড়ার ফিরিঙ্গিগুলোও এসেছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল দেখতে। তাদের জন্য টিকিটের মূল্য বেশি। বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য ৫০০ রুপি আর ভারতীয়দের জন্য ৫০ রুপি। আমি ৫০ রুপিতেই টিকিট পেলাম কিন্তু সাদা চামড়া হওয়ায় ফিরিঙ্গিদের ৫০০ রুপি খরচ করতে হলো। তবে আমার টিকিট জয়দীপদাই কেটে দিলো।

এখানে এসেই সবচেয়ে বেশি ছবি তোলা হলো। সাধারণত ঘুরতে বেরিয়ে আমি নিজের ছবি খুব কম তুলি। এখানে এসে ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। ঘুরতে ঘুরতে আমরা ভেতরে চলে এলাম। এখানে রানি ভিক্টোরিয়া, ব্রিটিশ ভারতের শাসন ও শোষণের কিছু নিদর্শন সযত্নে রাখা আছে। এই ভবনটা তৈরির ইতিহাস স্থিরচিত্রসহ সাজানো। গড়ের মাঠের জেলখানা সরিয়ে তৈরি হয় এই স্থাপনা।

১৯০১ সালের জানুয়ারিতে মারা যান ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া। তার মৃত্যুর সংবাদ লন্ডন থেকে টেলিগ্রামযুগে তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতার লাট ভবনের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। খবর পাওয়ার পরদিন থেকে দেশের অভিজাত সম্প্রদায় রানির মৃত্যুতে শোক পালনের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। বাঙালিও অংশ নেয় সেই প্রতিযোগিতায়।

রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি

যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্যোগে ফুটপাথ ধরে চারটি সারিতে কাঙালি ভোজন বা দরিদ্রনারায়ণ সেবা করানো হলো। তখনকার ভারতের গভর্নর জেনারেল ছিলেন লর্ড কার্জন। তিনি ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল বানানোর উদ্যোগ নেন। ময়দানের দক্ষিণ অংশে ক্যাথিড্রাল অ্যাভিনিউয়ের ওপর সেসময় জেলখানা ছিল। সেটিই পছন্দ হলো কার্জন সাহেবের। মেমোরিয়াল তৈরির জন্য সেই জেলখানা সরিয়ে নেওয়া হলো আলিপুরে। এটি এখন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগার হিসেবে পরিচিত। একে আবার স্বদেশি মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করা হয়েছে।

৫৪ একর জমির ওপর নির্মিত স্থাপনার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি রানির নাতি জর্জ প্রিন্স অব ওয়েলস, পরবর্তীকালের রাজা পঞ্চম জর্জের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মাধ্যমে। স্যার উইলিয়ম এমারসনের নকশায় বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে সাদা মার্বেলের এই সৌধ তৈরি হতে সময় লেগেছিল প্রায় ১৫ বছর। খরচ হয়েছিল ১ কোটি ৫ লাখ ভারতীয় মুদ্রা। খরচের জোগান এসেছিল রাজা-মহারাজা ও সাধারণ মানুষের কাছ থেকে। ৮ ফুট উঁচু, ৩৯৬ ফুট লম্বা এবং ২২৮ ফুট চওড়া মূল সৌধের চারদিকে চারটি টাওয়ার। ভেতরের দুটো তলা মিলিয়ে অনেকগুলো ঘর সাজানো হলো বিভিন্ন শিল্পবস্তু দিয়ে। ১৯২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল উদ্বোধন করেন প্রিন্স অব ওয়েলস অ্যাডোয়ার্ড অ্যালবার্ট।

ভিক্টোরিয়ার পাশেই ক্যাথিড্রাল চার্চ। রাতের বেলা চার্চে আলোকসজ্জা করা হয়। অনেক পর্যটকই রাতের ভিক্টোরিয়া ও চার্চের আলোকসজ্জার সৌন্দর্য দেখতে ভিড় জমান।

চলবে...

আগের পর্ব পড়ুন

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।