ঘরবন্দি মানুষের মুক্তির স্বাদ

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:১৮ পিএম, ০৯ ডিসেম্বর ২০২০

আকাশ মামুন

গৃহবন্দি দশা থেকে নতুন স্বাভাবিক (নিউ নরমাল) অবস্থায় প্রবেশ করেছে পৃথিবী। এ বন্দিদশায় প্রিয়জনের কাছে বা দূরে যেখানেই থাকুক-হাঁপিয়ে উঠেছে মানুষ। সহজেই অনুমেয় দীর্ঘ কারাবাসে মানুষের কতটা যন্ত্রণায় কাটে। ঘরবন্দি অবস্থায় বারবার মনে পড়েছে ইরানের কবি নাজিম হিকমাত, আফ্রিকার মানবতাবাদী নেলসন ম্যান্ডেলা কিংবা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শেখ মুজিবের লড়াইয়ের কথা।

এতসব দুঃসহ যন্ত্রণা আর মৃত্যুভয়ে কুঁকড়ে থাকা পৃথিবী ধীরে ধীরে আলোর দিকে যাচ্ছে। করোনার ভ্যাকসিন আসি আসি করছে। হঠাৎ সূর্য গ্রহণের মত দিনের মধ্যভাগে পৃথিবী যেমন অন্ধকারে ডুবে যায় করোনাও তেমনি পৃথিবীকে অন্ধকারে ডুবিয়ে দিয়েছিল। সেখান থেকে আংশিক শৃঙ্খলামুক্ত হয়েই আনন্দে নেচে উঠছে।

খুলতে শুরু করেছে দোকান, রেস্টুরেন্ট, পানশালা ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো। যাদিও আমেরিকার ওয়ায়োমিং অঙ্গরাজ্যে আনুষ্ঠানিক লকডাউনে যাওয়ার মত পরিস্থিতি হয়নি। তবে মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়েই অফিসকে ঘরে নিয়ে এসে স্বেচ্ছা ঘরবন্দি হয়ে পড়েছিল। একান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউ বাইরে বের হত না।

jagonews24

রাত নামলেই ডাউনটাউনগুলোয় ভুতুড়ে নির্জনতা নেমে আসত-গা ছমছম অবস্থা। সপ্তাহ শেষে যে সরাইখানাগুলো মানুষে গমগম করত-জেগে থাকতো মধ্যরাত পেরিয়ে; সেসবে এখন বিয়োগাত্মক নীরবতা বিরাজ করছে। এ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে জেগে উঠেছে পৃথিবী।

নতুন স্বাভাবিক অবস্থায় এই জেগে ওঠাকে উদযাপন না করলে কি আর হয়? তাই তো বেরিয়ে পড়লাম পাশের অঙ্গরাজ্য সাউথ ডেকোটার মাউন্ট রাশমোর ন্যাশনাল মেমোরিয়ালের উদ্দেশে। সড়ক পথে দূরত্ব তিনশ মাইল। সঙ্গী রাজেশ, সাকুর, ইভান, অভ্র, মাকসুদ, পার্থ, শর্মিষ্ঠা।

সূর্য ওঠার আগেই দুই গাড়িতে চেপে বেরিয়ে পড়লাম। অন্ধকার তখনো ঘিরে রেখেছে পৃথিবীকে। জনবসতিহীন বিস্তীর্ণ প্রান্তর, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে গাড়ির যান্ত্রিক আওয়াজে রাতের নির্জনতাকে ছিন্ন করে আমরা ছুটে চলছি।

jagonews24

শকুন্তলা গল্পের রাজা দুষ্মন্তের যাত্রাপথের মত আমাদেরও সামনে একদল হরিণ ডান থেকে পার হয়ে রাস্তার বামে চলে গেল। দুষ্মন্তের মত আমরাও সৌভাগ্যের লক্ষণ হিসেবেই ধরে নিলাম। শকুন্তলার সাথে দেখা হওয়ার আগে রাজা দুষ্মন্তের ডান বাহু কেঁপে উঠেছিল। আমাদেরও কেঁপে উঠল-বাহু নয়, মন। ভোর হওয়ার আগে আগে এমন আলো-আঁধারিতে একদল বন্যহরিণ দেখে যে কারোরই মন দুলে উঠবে।

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের আড়াল থেকে উঁকি দিতে শুরু করেছে সূর্য। প্রকৃতির আহ্বানে রাতের গর্ভ থেকে বেরিয়ে এসেছে সোনালি আলো। একটা নরম অনির্বচনীয় অনুভূতি-মাদকতা। এ মাদকতার লোভেই মন হয়তো অস্ফুট স্বরে বলে ফেলে, করোনা-এখনই সমাপ্তি চিহ্ন রেখো না। আরও কিছুটা সময় দাও-চোখ জুড়াই।

যখন মাউন্ট রাশমোরে পৌঁছলাম; সূর্য তখন বেশ ক্ষেপে আছে। ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুললে যেমন ক্ষেপে যায়-তেমনটা। যেন ক্রোধের আগুনে পুড়িয়ে দেবে সব। তার ক্ষিপ্ত চোখে তাকানোর কোনো স্পর্ধা না দেখিয়ে রোদ চশমায় চোখ ঢেকে নেমে পড়লাম গাড়ি থেকে। স্বাভাবিক সময়ে যেমন দর্শনার্থীদের কোলাহলে মুখর থাকে, তেমন নয়। খুব অল্পসংখ্যক দর্শনার্থী। মুখ ঢেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছে সবাই। তবুও মুক্তির আনন্দে যে উদ্বেলিত, তা সবার হাবভাবেই স্পষ্ট।

মাউন্ট রাশমোরে ব্ল্যাক হিলসের একটি উঁচু পাহাড়ের চূড়া কেটে আমেরিকার সাবেক চার রাষ্ট্রপতি জর্জ ওয়াশিংটন, থমাস জেফারসন, থিউডর রোজভেল্ট এবং আব্রাহাম লিংকনের আবক্ষ ভাস্কর্যের রূপ দেওয়া হয়েছে। ভাস্কর গুটজন বরগ্লুম ও তার ছেলে লিংকনের তত্ত্বাবধানে ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ষাট ফুট উঁচু ভাস্কর্যটির কাজ সম্পন্ন হয়। পাশে একটি জাদুঘর থাকলেও করোনার কারণে তা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত ছিল না।

jagonews24

হাতে সময় থাকায় আমরা ছুটলাম কাছের ব্যাডল্যান্ডস জাতীয় উদ্যানে। উদ্যান বললেও আসলে তেমন কোনো গাছ নেই এখানে। সারি সারি পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গভাবে। পাশেই রয়েছে বিস্তীর্ণ চারণ ভূমি; সেখানে চরে বেড়াচ্ছে বন্য ছাগল আর ষাঁড় (বাইসন)। আরও একটি অন্যতম আকর্ষণ প্রেইরি ডগ (তৃণভূমির কুকুর)। কাঁঠবিড়ালির মত ছোট আকৃতির প্রাণিটি খুবই চঞ্চল। দুষ্টু চঞ্চল শিশুরা যেমন বাড়িতে নতুন অতিথি এলে উঁকি দিয়ে আবার পালিয়ে যায়; তেমনই প্রেইরি ডগগুলোও আমাদের দেখামাত্রই গর্তে লুকিয়ে যেতে লাগল। কুড়ি মাইল দীর্ঘ চক্রাকার পথের স্থানে স্থানে থামার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে।

ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার উপক্রম। দিনের শুরুতে যে সূর্য ক্ষেপে ছিল, ক্রোধে চোখ রাঙিয়ে ছিল, তা এখন একেবারেই নিস্তেজ। তাড়া আছে তার। হয়তো ঘরে ফিরবে প্রিয়জনের কাছে। আমাদেরও ফিরতে হবে। জীবনানন্দের চিল যেমন ডানায় রোদের গন্ধ মুছে ফেলে, আমরাও তেমনই চোখে রোদের গন্ধ মুছে ফেলে আনন্দটুকু বুকপকেটে পুরে আবার ছুটলাম। গন্তব্য ওয়ায়োমিয়ের ছোট্ট শহর ল্যারামিতে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘হে পৃথিবী সুস্থ হয়ে ওঠো দ্রুত। মুক্তি দাও-মুক্তি নাও। প্রাণভরে শ্বাস আর চোখভরে দেখার দাও অবসর।’

লেখক: কবি ও কথাশিল্পী।

এসইউ/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।