স্বাস্থ্যঝুঁকিতে দেশের নারী-কিশোরীরা

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৯:৫৪ এএম, ১১ জুলাই ২০২০

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রার্দুভাবে থমকে গেছে বিশ্ব। প্রতিদিন আক্রমণের সংখ্যা বড়ছে। বাড়ছে মৃত্যুর মিছিলও। এ পরিস্থিতিতে বাল্য বিয়ে, অল্প বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাতসহ বিভিন্ন প্রকার ঘটনা ঘটছে প্রজনন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যের অভাবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য।

এদিকে গর্ভকালীন সেবা, নিরাপদ প্রসব ও পরবর্তী সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে নারী ও কিশোরীরা। কারণ, দেশের ১২ ভাগ নারী-কিশোরী এখনো তাদের স্বাস্থ্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারেনি। করোনা প্রার্দুভাবের আগে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরসহ বিভিন্ন সংস্থা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করলেও বর্তমানে এ ধরনের কর্মকাণ্ড অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়েছে। এমনকি জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাতায়াতসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা পার হয়ে নারীরা সেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে জনবল সঙ্কটও। ফলে নারী ও কিশোরীরা স্বাস্থ্য স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে।

অ্যাডভান্স ফ্যামিলি প্ল্যানিং (এএফপি) মিডিয়া অ্যাডভোকেসির টিম লিডার পুলক রাহা জানান, করোনা মহামারিতে গ্রাম ও শহর সব জায়গার মানুষ বলতে গেলে ঘরবন্দী অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তবে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন জায়গায় চলছে গোপনে বাল্যবিয়ের আয়োজন। করোনাকালীন আর্থিক সংকটের কারণে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো তাদের কিশোরী মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি বিদ্যালয় বন্ধ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়মিত সেবা প্রদান না করায় কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যও ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।

বিশ্বের ৪০ লাখ কন্যাশিশুকে বাল্যবিয়ের ঝুঁকিতে ফেলেছে করোনা মহামারি। স্কুল বন্ধ থাকা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়াসহ করোনা সম্পর্কিত নানা কারণ বাল্যবিয়ের ঝুঁকির মুখে পড়েছে বিশ্বের বিপুল সংখ্যক কন্যাশিশু। বাংলাদেশেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রভাবে বাল্যবিয়ের হার আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ অর্থনৈতিক। যেহেতু গবেষণা বলছে, করোনাভাইরাসের কারণে শহর-গ্রাম উভয় স্থানেই নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কমেছে প্রায় ৮০ ভাগ। অনেক ক্ষেত্রে কোনো রকমে তিন বেলা খেতে পারলেও পুষ্টিমান রক্ষা করতে পারছে না তারা। স্বাভাবিকভাবেই এসব পরিবারের কন্যাশিশুর লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

বৈশ্বিক পরিসংখ্যান বলছে, সংঘাত, দুর্যোগ কিংবা মহামারির সময় বাল্যবিয়ে বাড়ে। বাংলাদেশে ২০ শতাংশ মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, করোনার কারণে আরও ২০ শতাংশ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে। বাল্যবিয়ের ঝুঁকি এসব পরিবারেই বেশি।

কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সভাপতি নাসিমা আক্তার জলি বলেন, বাল্যবিয়ে রোধে সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অসহায় পরিবারের অবস্থা ফেরানোও জরুরি। এসব পরিবারকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির টাকা বাড়ানো এবং তা যথাসময়ে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি বাল্যবিয়ে রোধে আইন প্রয়োগের দিকেও নজর দিতে হবে।

বাল্যবিয়ের ক্ষতিকর প্রভাব বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভের (বিডিএইচএস) ২০১৭-১৮ প্রতিবেদন অনুযায়ী বাল্যবিয়ের হার ছিল ৫৯ শতাংশ। কিশোরী মায়ের গর্ভধারণের হার ছিল ২৮%, যা ২০১৪ সালে ছিল ৩১ শতাংশ। কিন্তু এই করোনাকালে এ সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে জনসংখ্যার ওপরও একটি চাপ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো নিয়মিত সেবা প্রদান না করার কারণে কিশোরীরা তাদের প্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে এবং বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হবে। পাশাপাশি বাল্যবিয়ের কারণে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ এবং বাড়িতে সন্তান প্রসব করতে গিয়ে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ছে।

বিডিএইচএস’র এর ২০১৭-১৮ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশের ৫২ শতাংশ নারী পরিবার পরিকল্পনার আধুনিক পদ্ধতি ব্যবহার করেন। ২০১৪ সালে পদ্ধতি ব্যবহারের হার ছিল ৫৪ শতাংশ, এক্ষেত্রে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার কমেছে। প্রতি ১০ জন নারীর মধ্যে ৪ জন নারী প্রথম বছর পদ্ধতি ব্যবহারের পর পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশ। পরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৭ শতাংশ।

করোনা মহামারিতে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো সীমিত আকারে স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু রেখেছেন। অধিকাংশ মানুষ ঘরে থাকার কারণে হাতের কাছে পরিবার পরিকল্পনার সেবা না পাওয়ার কারণে এই পদ্ধতি ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যার ফলে ঘরে থাকা অনেক নারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কারণে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশে আগামী দিনগলোতে শিশু ও মাতৃমৃত্যু বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ এই দেশগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা সেবার প্রায় ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভবনা রয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমবে এবং অনিরাপদ গর্ভপাত বাড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

সম্প্রতি পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের করোনাভাইরাসবিষয়ক পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির এক সভায় জানানো হয়, ২০১৯ সালে মার্চে প্রসবপূর্ব সেবা পাওয়া নারীর সংখ্যা ছিল ৪২ হাজার ৫২৬ জন। আর চলতি বছরের মার্চে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৬ হাজার ৪১৫ জনে। আর এপ্রিলে এই অবস্থা ভয়াবহ হয়। অথচ গত বছরের এপ্রিলে প্রসবপূর্ব সেবা গ্রহণ করে ৪২ হাজার ৫৭১ জন। চলতি বছরের এপ্রিলে সেবা পেয়েছে মাত্র ১৮ হাজার ৬২ জন। প্রতিষ্ঠানিক প্রসব কমে যাওয়ায় মাতৃমৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অধিকাংশ বাড়িতে প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যসেবা কর্মীর সেবা পাচ্ছে না এবং একই সঙ্গে প্রসব পরবর্তী পরিবার পরিকল্পনা সেবা দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

এবারের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাতে ২৯ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। মেরিস্টোপস বাংলাদেশের অ্যাডভান্স ফ্যামিলি প্ল্যানিং কার্যক্রমের সমন্বয়কারী মনজুন নাহার বলেন, করোনাকালীন এবং করোনা পরবর্তী সেবা নিশ্চিত করতে হলে এই বাজেট কতটা সহায়ক হবে তা এখনই ভেবে দেখা দরকার। পাশাপাশি বাজেটের সাঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা খাতে বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন।

তিনি জানান, স্থানীয় সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করতে পারলেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে না। পরিবার পরিকল্পনার পলিসিতে এ বিষয়ে কৌশলগত পরিবর্তন করতে না পারলে টিএফআর ২.৩ থেকে ২.০০-এ আনার পরিকল্পনা, পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের হার ৬২ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৭৫ শতাংশ উন্নীত করার পরিকল্পনা, অপূরণীয় চাহিদা ১২ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনা এবং বাল্যবিয়ের হার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে। উপরন্তু করোনাকালীন জনসংখ্যা বৃদ্ধির যে চাপ তৈরি হবে তা সামলানো অনেক কঠিন হয়ে পড়বে, যা দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক ভারাসাম্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করবে। তাই পরিবার পরিকল্পনা সেবা খাতকে অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা খাতের মতো সমভাবে বিবেচনা করে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে এই সেবাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

জেএ/এমএসএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।