চিকিৎসাসেবায় সফল নারী গাইনি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান


প্রকাশিত: ০৫:১৪ এএম, ০৮ মার্চ ২০১৬

দেশে চিকিৎসা শিক্ষা ও সেবায় অন্যতম সফল নারীদের একজন অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান। গাইনি ও অবস্টেট্রিক বিষয়ের দক্ষ শিক্ষক ও সুচিকিৎসক হিসেবে সারাদেশে যে কয়েকজন স্বীয়গুণে নাম, যশ ও খ্যাতি অর্জন করেছেন সেই তালিকায় তার অবস্থান শীর্ষে।  

গুণী এই চিকিৎসক বর্তমানে রাজধানীর শহীদ সোহরওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের গাইনি ও অবস্টেট্রিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার অধীনে চারটি ইউনিটে শতাধিক চিকিৎসক কাজ করছেন। সেই সঙ্গে তিনি অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশ (ওজিএসবি) এর মহাসচিব  হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রায় তিন যুগের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই চিকিৎসক প্রসূতি ও ধাত্রী সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরনের জটিল সমস্যা যেমন ফিস্টুলা, টিউমার, জরায়ু ও স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের দক্ষ হাতে সফল অস্ত্রোপচার করেন। সন্তান সম্ভবা মায়েরা নিরাপদ ডেলিভারির জন্য তার ওপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস রাখেন। মেডিকেল কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কোর্সের শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার বক্তব্য শুনেন।

চিকিৎসক বাবার ইচ্ছেতেই তিনি চিকিৎসক হয়েছেন। বাবার নির্দেশনা অনুযায়ী সততার সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ডা. ফারহানা দেওয়ান পেশাগত দায়িত্ব পালনে প্রতিদিন সকাল ৭টায় বাসা থেকে বেরিয়ে যান। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরকারি হাসপাতাল ও বিকেলে প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখে বাসায় ফিরতে ফিরতে তার রাত প্রায় ১০টা বেজে যায়।

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রাক্কালে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে অধ্যাপক ডা. ফারহানা দেওয়ান বাবার অনুপ্রেরণায় কিভাবে দেশের অন্যতম সেরা ও সফল চিকিৎসক হয়ে উঠলেন তার পেছনের গল্প তুলে ধরেন।

ডা. ফারহানা দেওয়ান জানান, তার বাবা মরহুম ইউনুস দেওয়ান (বিগ্রেডিয়ার জেনারেল) ছিলেন একজন সেনা চিকিৎসক। তিনি স্বাধীনতা পূর্ব তৎকালীন পাকিস্তানের স্বাস্থ্য বিভাগে যুগ্মসচিব পদে চাকরি করতেন। পাঁচ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। মূলত বাবার প্রেরণাতে তিনি চিকিৎসক হন।

তিনি জানান, ছোটবেলা থেকেই বাবা তাকে চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলবেন বলে জানিয়ে আসছিলেন এবং তিনিও সেভাবেই নিজেকে প্রস্তুুত করেন। বাবার বদলির সুবাদে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ছোটবেলায় নাইজেরিয়ার স্কুলে কয়েকবছর পড়াশুনা করেন।

Farhana

মেধাবী ফারহানা দেওয়ান তৎকালীন পাকিস্তানের একটি স্কুলের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ৮টি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ এসএসসি পাস করেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।

পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ৩৪তম ব্যাচে ভর্তি হয়ে ১৯৮২ সালে এমবিবিএস পাস করে সে বছরেই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন। পরবর্তীতে সফলতার সাথে গাইনিতে এফসিপিএস পাস করেন।

চাকরি জীবনে ঢাকা মেডিকেল, স্যার সলিমুল্লাহ মিটফোর্ড, সাবেক আইপিজিএমআর, হলি ফ্যামিলি, সিলেট ও রংপুর মেডিকেল কলেজে পর্যায়ক্রমে সফলতার সাথে অ্যাসিস্ট্যান্ট রেজিস্ট্রার, রেজিস্ট্রার, আবাসিক সার্জন, সিনিয়র কনসালটেন্ট ও ২০০৮ সাল থেকে অধ্যাপক (নিয়মিত) পদে চাকরি করছেন।
 
গাইনি চিকিৎসক হিসেবে সফলতার পেছনের গল্প জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢামেকে (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) পড়াশুনা ও পরবর্তীতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পর দিনরাত ২৪ ঘণ্টা পড়াশুনা ও রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকতেন। সিনিয়র চিকিৎসকরা কিভাবে রোগীকে কোন পদ্ধতিতে কি ওষুধে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে তুলছেন তা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে দেখতেন। পেশার প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হলে কেউ সফল হতে পারে না বলে মনে করেন তিনি।

কর্মজীবনে সফলতার জন্য নিজ দেশ ছাড়াও তার সুনাম বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আর তাইতো চিকিৎসক হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ চষে বেড়িয়েছেন। ডা. ফারহানা দেওয়ান জানান, বিশ্বের খুব কম দেশই আছে যেখানে তার যাওয়া হয়নি।

তিনি জানান, পেশাগত কাজে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়াতে এক মাস করে প্রশিক্ষণ গ্রহণ কর্মজীবনে খুব কাজে লেগেছে। ২০১১ সালে জাতিসংঘে হোয়াইট রিবন এলায়েন্স ফর সেইফ মাদারহুড ডেলিগেশন ফর ইউএন জেনারেল এসেম্বলি উইকে আমন্ত্রিত অতিথি হয়ে বক্তব্য রাখেন। সেখানে তিনি মাতৃ ও শিশু মৃত্যু হ্রাসে বাংলাদেশের সফলতা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। ২০১৫ সালে কানাডার ভ্যানকোভারে দি ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব গাইনিকোলজি অ্যান্ড অবসট্রেটিক (এফআইজিও) আন্তজার্তিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে বক্তৃতা করেন। নিয়মিতভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সভা সেমিনারে গিয়ে গাইনি চিকিৎসায় সফলতার গল্প নিয়ে বক্তব্য রেখে চলেছেন।

তিনি জানান, তার সকাল শুরু হয় ৭টায়। ৮টার আগেই কর্মস্থল শহীদ সোহরওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে প্রয়োজনীয় মিটিং সেরে এমবিবিএস ও পোস্ট গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের ক্লাস গ্রহণ, রোগী দেখা ও অস্ত্রোপচার করেন। সরকারি হাসপাতালে গরিব রোগীদেরকে অস্ত্রোচাারের জন্য নিজের পকেটের টাকা খরচ করেন।
 
Farhana

তিনি আরো জানান, বিকেল ৪টা থেকে ৯টা পর্যন্ত সপ্তাহে তিনদিন করে রাজধানীর ইউনাইটেড ও সেন্ট্রাল হাসপাতালে চেম্বার করেন। রোগী দেখা ছাড়াও অস্ত্রোপচার করেন তিনি।

তিনি বলেন, এ প্রজম্মের নারী চিকিৎসকরা পেশায় সফলতার স্বাক্ষর রাখছেন। গাইনিসহ বিভিন্ন বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে অনেকেই গ্রামে গিয়ে রোগী দেখছেন। তবে নবীন চিকিৎসকরা পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের চাইতে কিভাবে দ্রুত টাকা পয়সা, বাড়ি গাড়ি করা যায় সেদিকে বেশি ঝুঁকছেন। তারা ভীষণ উচ্চাকাঙ্ক্ষী। তাদের সময় এমনটা মোটেই ছিল না বলেও জানান তিনি।

চিকিৎসক হিসেবে সফল এই নারীর স্বামী মাসরুল আলম চৌধুরীও একজন সফল গার্মেন্টর্স ব্যবসায়ী। তাদের সংসারে দুটি সন্তান। বড় মেয়ে মারিহা আলম চৌধুরী পেশায় এফসিপিএস পাস করা চিকিৎসক। ছেলে বনানীতে একটি স্কুলে পড়াশুনা করছে।
 
ডা. ফারহানা দেওয়ান জানান, তার শ্বশুরালয় ঢাকার নবাবগঞ্জের পাড়াগ্রাম নামের একটি গ্রামে প্রতিমাসে দুই তিনবার গিয়ে একটি দাতব্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রদান করেন। সাক্ষাতকারের শেষ পর্যায়ে তিনি বলেন, বাবার নির্দেশনা অনুযায়ী সততার সাথে মহান চিকিৎসা পেশার দায়িত্ব পালন করছেন।

এমইউ/এসকেডি/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।