দুর্গম এলাকার স্বাস্থ্য আপা আজিজা


প্রকাশিত: ০১:১৯ পিএম, ০৮ মার্চ ২০১৬

নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলার বংশিরদিয়া গ্রামের মেয়ে আজিজা বেগম। জন্মগ্রহণ করেছেন অতি সাধারণ এক পরিবারে। বাবা চাঁন মিয়া ছিলেন সরকারি চাকরিজীবী।

আজিজা ১৯৮৪ সালে এসএসসি পাশ করেছেন পুটিয়া হাইস্কুল থেকে। এর পর থেকে দীর্ঘদিন ছিলেন পড়াশুনার সংস্পর্শ ছাড়া। কিন্তু তিনি ছিটকে পড়েননি। পূণরায় পড়াশুনার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এবার আর জেনারেল নয়। এমন কিছু পড়তে চান যেন অতি সাধারণ মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়জিত করতে পারেন। আর সে সূত্র ধরেই ১৯৯২ সালে ভর্তি হন ঢাকার সাভার গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে। ৪ বছর অত্যন্ত ধৈর্য্যের সঙ্গে লেখাপড়া করেছেন। প্যারামেডিক কোর্স শেষ করেই মানবতার সেবায় নেমে পড়েন তিনি।

অত্যন্ত মেধা সম্পন্ন আজিজাকে একই প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়া হয় প্যারামেডিক হিসেবে। টানা ৩ বছর সেখানে কাজ করে নিজেকে আরও একটু ঝালিয়ে নেন তিনি। এর পর আর থেমে থাকেননি।

১৯৯৯ সালে জাতীয় তরুণ সংঘ সংস্থার সূর্যের হাসি ক্লিনিকে প্যারামেডিক হিসেবে যোগ দেন। তাকে পদায়ন করা হয় মানিকগঞ্জ জেলায়। এর মধ্যেই বিয়ে করেন সিরাজগঞ্জ জেলার ধুকুরিয়া ভদ্রঘাট গ্রামের বাসিন্দা আরেক স্বাস্থ্যকর্মী নজরুল ইসলামকে। তিনি বর্তমানে ময়মনসিংহে সূর্যের হাসি ক্লিনিকে কর্মরত আছেন। তাদের সংসারে রয়েছে একমাত্র ছেলে তাওহিদুল ইসলাম।

১৯৯৯ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত আজিজা সেবা দেন সূর্যের হাসি ক্লিনিকে। ২০০৮ সালে যোগ দেন সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলায় সীমান্তিক পার্টনার সূর্যের হাসিতে। সেখানে কাজ করেন এক বছর। ২০০৯ সালে পপি অরগানাইজেশনে প্যারামেডিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ কল্যাণ সংস্থায় কিশোরগঞ্জ জেলায় যোগ দেন। এক বছর পরই সেখান থেকে চলে আসেন। একেবারেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করতে ২০১১ সালের পহেলা ফেব্রুয়ারি যোগ দেন মা মনি প্রকল্পে। সংস্থাটি তাকে নিয়োগ দেয় হবিগঞ্জ জেলার ভাটি উপজেলা আজমিরীগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল শিবপাশা ইউনিয়ন স্বাস্থকেন্দ্রে। তখন থেকে বর্তমান পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত আছেন। সরকারি স্বাস্থ্য কর্মসূচির সহায়তার জন্য তাকে সেখানে নিয়োগ দেয়া হয়।

জাগো নিউজকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে হাওর বেষ্টিত এ অঞ্চলে কাজের নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানান আজিজা। শুরুর দিকে হাওরাঞ্চলে কাজ করতে গিয়ে ভয় আর আতঙ্কের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এখানে যোগদানের সময় এলাকার পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত করুণ, ভয়াবহ। এখানকার মানুষেরা সব সময় দাঙ্গাহাঙ্গামা আর খুনখারাবিতে লিপ্ত থাকতো। আমার যোগদানের পরদিনই তারা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণ চালায়। পুলিশ সদস্যদের মারধর করে আহত করে। ভেঙে চুরমার করে দেয় দরজা-জানালাসহ আসবাবপত্র। তা দেখে এখানে কাজ করতে পারব কি-না তা নিয়ে মারাত্মক ভয়ে ছিলাম। প্রথম রাতটা এ প্রকল্পেরই এক সহকর্মীর বাড়িতে কাটাই। পরদিন কর্মস্থল থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে সেখানে চলে যাই।

কয়েকদিনের মধ্যেই জানতে পারি এখানকার মানুষজন অসচেতন। তাদের কেউ কিছু বুঝালেও বুঝতে চাইতোনা। আর এ এলাকার রাস্তাঘাট ছিলনা বললেই চলে। নোংরা কাদামাটি মেরেই ফিল্ডে কাজ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই। সবচেয়ে বেশি শোচনীয় ছিল শিবপাশা ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ স্বাস্থকেন্দ্রটির অবস্থা। কোনো আসবাবপত্র তো ছিলই না, সরকারি কোনো স্টাফও ছিলনা। গরু-ছাগলের আশ্রয়স্থল ছিল এটি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আবাসিক ঘরটির আবস্থাও প্রায় একই রকম ছিল। ভাঙ্গা ছাদ, দরজা-জানালাও ছিল ভাঙ্গা। বখাটেদের জোয়ার আড্ডাখানা ছিল এটি।

Habigonj-Ajija-Pic

দুর্গত এ এলাকার মানুষেরা কখনওই স্বাস্থ্যসেবা পেতোনা। তারা ছিল অত্যন্ত নিপীড়িত। স্বাস্থকেন্দ্রটিতে ভিজিটরের পদ থাকলেও বাস্তবে তেমন কেউ এখানে কাজ করতোনা। যারা মাঝে মাঝে আসতো তারাও এলাকার পরিস্থিতি খারাপ থাকায় কোনো কাজ না করেই চলে যেত। ফলে এ এলাকার মানুষ পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি বিশেষ করে মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সচেতনতা সম্পর্কে ছিল ঘোর অন্ধকারে।

আমি এলাকা ঘুরে জানতে পারি ভিজিটররা এখানকার মানুষকে নির্বোধ বলে অবজ্ঞা করতো। কঠিন এ পরিস্থিতিতে কি করবো তা ভেবে পাচ্ছিলাম না। হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাচ্ছিলাম। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিলাম বসে থাকা যাবেনা। এটিকেই আমার চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিই। ভাবলাম যদি এ এলাকার মানুষের জন্য কিছু করতে পারি তবে শিবপাশার মানুষ আমাকে চিরকাল শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। তাদের মধ্যে আমি পরিবর্তন আনবোই। এ প্রতিজ্ঞা থেকেই মূলত কাজ শুরু করি।

২৭ হাজার (২০১১ সালের হিসেবে) জনসংখ্যার শিবপাশা ইউনিয়নের ১২টি মহল­াকে ৪টি ইউনিটে বিভক্ত করে কাজে নামি। ১২টি স্যাটেলাইট স্পটে পায়ে হেঁটে গর্ভবতী মায়েদের খুঁজতে থাকি। তাদের স্যাটেলাইট স্পটে এনে সেবা দিতাম। হাসপাতালে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতাম। সমাবেশ করতাম। গর্ভবতী মায়েদের নিয়ে উঠান বৈঠক করতে শুরু করি। এর মাধ্যমে বুঝাতে চেষ্টা করি শিবপাশা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কী কী সেবা দেয়া হয়। মা মনি প্রকল্পের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আদর্শ সম্পর্কে তাদের বুঝাই। প্রতিটি ঘরে ঘরে গিয়ে মা ও শিশুদের সেবা সম্পর্কে ধারণা দিই। কিছু দিনের মধ্যেই কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবী বোন তৈরি হয়। তাদের নিয়ে মা মনি প্রকল্পের মাইক্রোগ্রাম সভা করি। তাদের সহযোগিতা নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কাউন্সিলিং করি।

তিনি বলেন, সারাদিন গ্রামে গ্রামে ঘুরে রাতে বাসায় গিয়ে দেখতাম বৃষ্টির পানিতে বিছানাপত্র সব ভিজে গেছে। টিনের চাল ছিদ্র হওয়ায় বৃষ্টির পানিতে ঘর ভেসে যেতো। ফলে অনেক রাতই ঘরের এক কোণে বসে কাটিয়েছি। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সারা দিন আবার পাড়া মহল­ায় ঘুরেছি মানুষের দ্বারে দ্বারে। শারিরীক পরিশ্রমের পাশাপাশি নির্ঘুম রাত কাটিয়ে অনেকটা ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ি। তাছাড়া স্বামী-সন্তান পাশে না থাকায় মানসিকভাবেও অনেকটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। একবার ভাবলাম এখান থেকে পালাই। পরক্ষণেই চিন্তা করি আমি চলে গেলে এ এলাকার মানুষের কি হবে। জীবন যুদ্ধে আমি হারতে চাইনা। আমাকে জিততে হবেই। শিবপাশার মানুষের মুখে আমি হাসি ফুটিয়ে তুলবো অবশ্যই। এমন মনোভাব থেকে কাজের গতি আরও বাড়িয়ে দিই।

মহীয়সী এ নারী বলেন, একই বছরের ১১ অক্টোবর প্রকল্পের সহায়তায় স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি মেরামত করা হয়। সে সময় মা মনি প্রকল্প থেকে আমার সহযোগী হিসেবে আরও ২ জন প্যারামেডিক ও ২ জন সাপোর্ট স্টাফ নিয়োগ দেয়া হয়। তাদের রেখে আমি হবিগঞ্জে ৩ মাসের জন্য সেভ ডেলিভারী প্রশিক্ষণে চলে যাই। ট্রেনিং শেষে আবারও কর্মস্থলে যোগদান করি। এর পর থেকে এ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এক হাজারেরও উপর ডেলিভারী হয়। আমার অন্য সহকর্মী নাসরীন আক্তারও খুবই অভিজ্ঞ একজন প্যারামেডিক। অপরজন পাপিয়া আক্তারও কম নন। আমি তাদের কাজে প্রেরণা দিই, কাজের প্রশংসা করি। আল­্লাহর অশেষ মেহেরবাণী যে, এসব ডেলিভারির মধ্যে একজনও মা ও শিশু মারা যায়নি। যা আমাদের প্রকল্পেরও মূল উদ্দেশ্য ছিল।

কাজের স্বীকৃতি হিসেবে সম্মাননা পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন মানবতার সেবায় নিজেকে নিয়োগ করা নারী আজিজা।

তিনি জানান, ২০১২ সালে নিরাপদ প্রসব সেবা প্রদানের জন্য সিলেট বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার অর্জন করেন তিনি। এর পর ২০১৩ সালে পান নিরাপদ শিশু সেবা প্রদানে সিলেট বিভাগে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। এ সম্মাননা তাকে আরও অনুপ্রাণীত করেছে। তাকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। সব শেষ ২০১৪ সালে মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার জন্য পেয়েছেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার গ্লোবাল লিগ্যাসি অ্যাওয়ার্ড। যা তিনি গ্রহণ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক থেকে। তার হাতে এ পুরস্কার তুলে দিয়েছেন পুলিৎজার পুরস্কার জয়ী নিউইয়র্ক টাইম-এর সাংবাদিক নিকোলাস ক্রিস্টফ। আর এ সম্মাননাই তাকে ধন্য করেছে বলে তিনি জানান।

সবশেষে তিনি দাবি জানান, মা মনি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যদি তাকে কাজের স্বীকৃতি হিসেবে পদোন্নতি দেয়, তবে তিনি ইউনিয়ন কেনো পুরো জেলায়ই নিজের কাজের পরিধি প্রসারিত করতে পারবেন। জনগণের সেবাই যেন তার জীবনের লক্ষ্য হয় সে জন্য তিনি সকলের সহযোগিতা ও দোয়া কামনা করেন।

এফএ/ এমএএস/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।