সন্তানের জন্য দুধ চেয়েও পাইনি, তাই গরুর খামার করেছি


প্রকাশিত: ০৫:০০ এএম, ০৯ মার্চ ২০১৬

একমাত্র সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য এলাকার অনেকের কাছে দুধ চেয়েছিলাম। টাকা দিতে পারবো না ভেবে কেউ একটু দুধ দেয়নি বাচ্চাটাকে খাওয়ানোর জন্য। দুধের পরিবর্তে সন্তানকে ভাতের মার (ফ্যানা) খাওয়াইছি। তখন থেকেই মনের মধ্যে জেদ শুরু হয়েছিল একটি গরুর খামার তৈরি করার। এভাবেই খামার গড়ে তোলার কাহিনী বলছিলেন রাজবাড়ীর লজি বেগম।

এরপর একটি এনজিও থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি গাভী কিনেন লজি। সেটি দিয়েই শুরু করেন খামার পরিচালনা। এরপর একে একে আরো কয়েকটি গরু কিনেন তিনি। সেই থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি লজি বেগমকে। এখন তিনি লজি ডেইরি ফার্মের (খামার) মালিক। তার খামারে এখন ছোট-বড় মিলে ২৩টি গরু রয়েছে।
 
খামারের পাশাপশি গুরুর গোবর দিয়ে তৈরি করছেন বায়ু গ্যাস প্ল্যান্ট ও বার্মী কম্পোস্ট সার। তৈরিকৃত এ গ্যাস দিয়ে নিজের পরিবারের ৩ বেলার রান্না ও গরুর প্রয়োজনীয় খাবার রান্না করে থাকেন এবং বার্মী কম্পোস্ট সার দিয়ে কৃষি কাজে ব্যবহার করাসহ বিক্রি করছেন তিনি।
 
Lozi-Rajbari

বর্তমান সময়ে দেশ যখন সবার সম্মেলিত প্রচেষ্টায় মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হচ্ছে। সেখানে নারীদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমনি একজন নারী রাজবাড়ীর লজি বেগম। যিনি গাভী পালন করে এখন সাবলম্বী।

লেখাপড়া তেমন না জানলেও লজি বেগমের বুদ্ধিমত্তা ছিল প্রখর। ১৪ ভাই বোনের সংসারে বেশি লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তার। ১৬ বছরে পা রাখতেই বিয়ে হয় লজি বেগমের । বিয়ে পরেই অভাব অনটনে দিন কাটতে থাকে। কারণ তার স্বামী তখনো ছাত্র ছিল। স্বামী ছাত্র হবার কারণেই সম্পূর্ণ শ্বশুরের উপর নির্ভরশীল হতে হয় তাদের। দিন যত অতিবাহিত হতে থাকে পরিবারে সমস্যা তত বাড়তে থাকে। সমস্যা থেকে উত্তোলনের জন্য নারী হয়েও নেন এই গাভী পালনের উদ্দ্যোগ। আর উদ্দ্যোগে জীবন যুদ্ধে সফল নারী লজি বেগম।

সফল এই খামারি লজি বেগম জেলা সদরের দাদশী ইউনিয়নের নূরপুর এলাকার মৃত আব্দুর রাজ্জাকের মেয়ে ও একই এলাকার শহিদুল ইসলামের স্ত্রী।

২০০৬ সালে একটি এনজিও থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে একটি দেশি গাভী দিয়ে খামার পরিচালনা শুরু করেন লজি বেগম। বর্তমানে তার খামারে রয়েছে ছোট-বড় ২৩টি গরু। যার মধ্যে রয়েছে ১২টি দুগ্ধ গাভী, ১টি ষাড় গরু ও বাকিগুলো বকনা বাছুর। ধারণা করা হচ্ছে যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ৩৫ লক্ষ টাকা।

Lozi

প্রতিদিন এই খামার থেকে ৪০ থেকে ৪৫ লিটার দুধ পাচ্ছেন। যা দিয়ে পরিবার বা খামারের খরচ অনেকটা মেটানো হচ্ছে।
এখন লজি বেগমের পরিবারের সব অভাব অনটন দূর হয়ে গেছে। লজি বেগমের এ খামার দেখে এখন আশেপাশের লোকজনও গাভী পালনে গুরুত্ব দিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ছোট পরিসরে খামার গড়ার চেষ্টাও করছে।

সফল খামারি হিসেবে লজি বেগম বঙ্গবন্ধু জাতীয় পুরষ্কার, জেলা জয়ীতা পুরষ্কার ও অর্থনীতিতে সাফল্য অর্জনে ২য় জয়ীতা পুরষ্কারসহ সনদ পেয়েছেন।

খামার পরিচর্যাকারী লজি বেগমের স্বামী শহিদুল ইসলাম বলেন, আসলে এ খামারের মূল উদ্দ্যোক্তা তার স্ত্রী লজি বেগম। তার উদ্দ্যোগ আর অসীম সাহসের ফসল এই খামার। তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে খামারের গরুর খাবার, দুধ সংগ্রহ করা, গরুর ঘর পরিষ্কার, গরুকে পরিষ্কার করাসহ প্রয়োজনীয় সব কাজ করেন।

প্রতিবেশি রফিকুল ইসলাম বলেন, লজি বেগম প্রথমে ছোট্ট পরিসরে এ ডেইরি ফার্মটি শুরু করে ১টি গাভী দিয়ে। এখন পর্যায় ক্রমে খামারে ২২-২৩টি গাভীতে পরিণত হয়েছে। এর দেখাদেখি আশপাশে আরো ২টি ফার্ম গড়ে উঠেছে। তিনি নিজেও একটি করেছে। সরকারি কোনো অনুদান তারা পান না। তাই সরকারের কাছে তাদের অনুরোধ সরকারি সাহায্য সহযোগিতা পেলে তারা অনেক কিছু করে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবে।

Lozi

লজি বেগম বলেন, তার প্রথম বাচ্চা জন্ম নেবার পর অনেক স্থানে দুধের জন্য গেলে কেউ দিতে চায়নি। এই ভেবে যে তিনি টাকা দিতে পারবেন কিনা। সন্তানকে দুধের পরিবর্তে অনেক সময় ভাতের মার খাইয়েছি।

তিনি আরোও বলেন, প্রতিদিন ভোরে খামার তিনি ও তার স্বামী পরিষ্কার করেন। খামারে কোনো দুর্গন্ধ নেই। পর্যাপ্ত আলো বাতাস রয়েছে। তাছাড়া তিন বেলা নিয়ম অনুযায়ী খাবার দেওয়া হয়। নিয়মিত চিকিৎসার জন্য সব সময় জেলা প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের পরামর্শ নিয়ে থাকেন। যেকোনো সময়ে বিপদে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের পাশে পেয়েছেন। সময় মতো ভ্যাকসিন, প্রশিক্ষণসহ যা যা প্রয়োজন সব দিয়েছেন। আর সরকারের পক্ষ থেকে বীজ তৈরির জন্য তার খামার থেকে ২টি গাভী নিয়েছেন।

জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা নিরুত্তম কুমার বলেন, লজি বেগম রাজবাড়ীর একজন সফল খামারি। ১টি গাভী থেকে আজ তার অনেকগুলো গাভী। তাছাড়া তার খামারের পরিবেশ অত্যন্ত ভালো। কোনো দুর্গন্ধ নেই। সব সময় তিনি গাভীগুলোর সঠিক পরিচর্যা করার জন্যই ধারাবাহিকভাবে তিনি সফল হয়ে আসছেন। তাদের কাছে যখন যে সহযোগিতা চেয়েছেন তারা তা দেবার চেষ্টা করেছেন।

এমএএস/পিআর

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।