আবেস ইনতেসার অনিক
বাংলাদেশের ৬৪ জেলা ভ্রমণ করেছি। দেখেছি বাংলার সবুজে মোড়ানো অপরূপ প্রকৃতি। মিশেছি গ্রামবাংলার সহজ-সরল মানুষের সঙ্গে। চিনেছি প্রিয় জন্মভূমিকে। বাংলাদেশকে চেনার জন্য ২০২২ সালের অক্টোবরে ৬৪ জেলা ভ্রমণের জন্য যাত্রা শুরু করি। আমার এই ভ্রমণ শেষ হয় ২০২৫ সালের ৬ নভেম্বর। নদী-নালা, হাওর, পাহাড়, সমুদ্র, সমুদ্রসৈকত, দ্বীপ, চা বাগান, ঐতিহাসিক স্থাপনা; কী নেই দক্ষিণ এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এই দেশে? তুষারপাত বাদে সবই আছে। যেখানে তাকাই; সেখানেই পর্যটনের সম্ভাবনা। দুঃখজনক হলেও সত্য, এত এত পর্যটন আকর্ষণ থাকার পরও প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় আমরা পর্যটন শিল্পে অনেক পিছিয়ে।
সবুজে মোড়ানো অসাধারণ প্রকৃতি ছাড়াও আছে নানা ঐতিহাসিক স্থাপনা। দেশের সবক’টি জেলায়ই আছে কোনো না কোনো ঐতিহাসিক স্থাপনা। এরমধ্যে বেশিরভাগ স্থাপনাই পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে। কোনোটা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। অথচ স্থাপনাগুলো ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে অতীত ইতিহাসের প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরার কথা ছিল। স্থাপনাগুলোকে রক্ষণাবেক্ষণ করা গেলে বড় একটা আয় করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
ভ্রমণের সুবাদে অনেক জমিদারবাড়ি ও ঐতিহাসিক স্থাপনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। বেশিরভাগ স্থাপনাকে ধ্বংসাবস্থায় দেখাটা দুর্ভাগ্যের ছিল। এখনো ইতিহাস ও কালের সাক্ষী হয়ে অনেক স্থাপনাই দাঁড়িয়ে আছে। এখনো আমাদের হাতে সুযোগ আছে সেগুলোকে রক্ষা করার। পর্যটন শিল্প বিকাশে কাজে লাগানোর। একটি অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, ২০২৩ সালের মার্চে আমরা ৩ জন বাগেরহাট ভ্রমণ করি। সেখান থেকে সুন্দরবনের করমজলে যাই। করমজল যাওয়ার জন্য মোংলা ঘাট থেকে বোট ভাড়া নিতে হয়। আমরা ১৩০০ টাকা দিয়ে একটি বোট ভাড়া নিয়ে করমজল ঘুরতে যাই।
করমজল ঘুরে সেই বোটে মোংলা ঘাটে ফিরি। করমজল যাত্রা শেষে যখন বোটের মাঝিকে টাকা দিই; তখন মাঝি বলেন, ঘাটে থাকা অন্য মাঝিরা নাকি তাকে বলেছে, আমাদের পোশাক দেখে বড়লোক মনে হয়। তাই আমাদের থেকে যেন ২০০০ টাকার বেশি নেয়। দেশের বেশিরভাগ মানুষ অনেক অতিথিপরায়ণ এবং মিশুক। তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অল্প কিছু মানুষ আছে, যারা মনের ভেতর প্রতারণামূলক আচরণ পোষণ করে রাখেন। দুর্ভাগ্যবশত সেই মানুষগুলোই পর্যটনের সঙ্গে যুক্ত। তারা সুযোগ পেলেই পর্যটকদের কাছ থেকে মাত্রাতিরিক্ত অর্থ আদায়ের চিন্তায় মগ্ন থাকেন।
২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে পারিবারিক সফরে সিলেটের জাফলং গিয়েছিলাম। জাফলং থেকে মায়াবী ঝরনায় নৌকায় যেতে হয়। যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ ৫ মিনিট। সেই ৫ মিনিটের ছোট নৌকা যাত্রার বর্তমান ভাড়া জনপ্রতি ১০০ টাকা করে। এ ছাড়া যখন ফেনী জেলা ভ্রমণ করি; তখন ফেনীর মহিপাল থেকে একটি সিএনজি রিজার্ভ করে প্রতাপপুর জমিদারবাড়ি ও শশর্দী উপজেলার শশর্দী মসজিদ ঘুরে মহিপালে ফেরত আসি। সব মিলিয়ে ৪৪ কিলোমিটারের ভাড়া নিয়েছে ১০০০ টাকা।
আরও পড়ুনপাহাড়-বনের সৌন্দর্য ‘গজনী অবকাশ কেন্দ্র’স্থাপত্যশৈলীর অনন্য নিদর্শন মুড়াপাড়া জমিদারবাড়ি
ছুটির দিনে দেশের পর্যটন স্পটে গেলে দেখা যায়, গাড়ি চালক থেকে শুরু করে হোটেল; পর্যটকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে। তা নিয়ে প্রতিযোগিতা চলে। বেশিভার সময়ই পর্যটকেরা কার কাছে অভিযোগ করবেন, কী ব্যবস্থা নেবেন; তা বুঝে উঠতে পারেন না। স্যোশাল মিডিয়ায় দেখেছি, কক্সবাজারে ট্যুরিস্ট পুলিশ পর্যটকদের হয়রানিসহ নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। অভিযান কতদিন চলবে তা নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। যেমনটা বলেছিলাম, বাংলাদেশের সবক’টি জেলায় আছে কোনো না কোনো দর্শনীয় স্থান। কিন্তু প্রচারণা ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে সেগুলোকে ট্যুরিজমের কাজে লাগানো যাচ্ছে না।
পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উচিত জায়গাগুলোকে সঠিক প্রচারণার মাধ্যমে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের কাছে তুলে ধরা। এখন সবকিছুই প্রযুক্তিনির্ভর। তাই প্রযুক্তি ব্যবহার করে আকর্ষণীয় স্থানগুলোকে প্রমোট করা যেতে পারে। দেশে অনেক ভালো ভালো ট্রাভেল কনটেন্ট ক্রিয়েটর আছেন। মন্ত্রণালয়ের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সেসব কনটেন্ট ক্রিয়েটর দিয়ে স্পটগুলোর প্রচার করা যেতে পারে। দেশি ট্রাভেল কনটেন্ট ক্রিয়েটরদের পাশাপাশি বিদেশি কনটেন্ট ক্রিয়েটর দিয়েও পর্যটন স্পষ্টগুলোর প্রমোট করা যেতে পারে। এতে বিদেশি পর্যটকেরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানবেন। বাংলাদেশে ভ্রমণ করবেন। পর্যটন খাতে দেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হবে বৈদেশিক মুদ্রা।
মাঝেমাঝে বিদেশি পর্যটকদের হয়রানির বিষয়টি দেখতে পাই। এটি রোধের জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ কাজ করতে পারে। দেশের সব জেলায়ই পর্যটন স্পট আছে। সবগুলো জেলায় ট্যুরিস্ট পুলিশ অ্যাকটিভ থাকা প্রয়োজন। বিদেশি পর্যটকেরা যখন দেশে অবতরণ করবেন; তখন ইমিগ্রেশন শেষ করার পর একটি করে ইংরেজি ভাষার লিফলেট দেওয়া যেতে পারে। লিফলেটে ৬৪ জেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর বিস্তারিত বিবরণ থাকবে। সব জেলার ট্যুরিস্ট পুলিশের জরুরি ফোন নম্বর দেওয়া থাকবে। যাতে বিদেশি পর্যটক কোনো দর্শনীয় স্থান ঘুরতে গিয়ে যদি হয়রানি বা সমস্যায় পড়েন, তাহলে লিফলেটে দেওয়া ট্যুরিস্ট পুলিশের নম্বরে যেন যোগাযোগ করতে পারেন। এতে বিদেশি পর্যটকেরা ভালো ভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন। বিশ্ব পর্যটন শিল্পে আমাদের অবস্থান দৃঢ় হবে।
তরুণ প্রজন্মকে দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশে কাজে লাগানো যেতে পারে। বর্তমানে দেশের তরুণ সমাজের বড় অংশ কোনো না কোনো দিক দিয়ে দক্ষ। এই দক্ষ তরুণ শক্তিকে যদি ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারি, তাহলে বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প এগিয়ে যাবে। এ ছাড়া সমাজে বেকারত্ব দূর করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে। সুতরাং দক্ষ জনশক্তি এবং সঠিক ব্যবস্থাপনাই পারে দেশের অপার সম্ভবনাময় পর্যটন শিল্পকে বিকশিত করতে। বিশ্বের পর্যটন শিল্পে আমাদের দেশের নাম তুলে ধরতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, বিবিএ চতুর্থ বর্ষ, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ।
এসইউ