ফিচার

অপ্রতিরোধ্য হাদির বিদ্রোহ ও ন্যায়ের যাত্রা

ইফতেখার রবিনন্যায় ও ইনসাফের পক্ষে এক অপ্রতিরোধ্য কণ্ঠস্বর ছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। চব্বিশের জুলাইয়ের ইতিহাসে তার নাম মিশে আছে এক অনন্য সাহস, এক অক্লান্ত বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে। ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হিসেবে তিনি শুধু বক্তব্যই দেননি তিনি হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলনের জীবন্ত প্রতীক। এক গুলির বিপরীতে সপ্তাহব্যাপী লড়াই করার পর তিনি রেখে গেছেন সেই শব্দগুলো যা তার জীবনের মতোই দৃঢ়, অনন্ত এবং অমোচনীয় সাহস, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ।

কোটি মানুষের প্রার্থনার বিপরীতে, জীবন বিনাশের হুমকির মাঝেও তিনি থেমে যাননি। মাত্র ৩২ বছরের এই স্বল্প জীবনেই হাদি এমন এক স্থান অধিকার করলেন, যা অনেকের জীবনের বহু বছরেও সম্ভব নয়। মানুষের হৃদয়ে নিজের নাম লেখা, তাদের আশা-ভরসার প্রতীক হওয়া সবই ঘটল অল্প সময়ে।

ঝালকাঠি জেলার জন্ম নেওয়া এই বীর ২৪ সালের জুলাইয়ে নতুনভাবে আবিষ্কৃত হলেন। গণঅভ্যুত্থানের উত্তাপে, স্লোগান, মিছিল ও বিদ্রোহের মিশেলে গড়ে উঠলো তার পূর্ণাঙ্গ প্রাণ। তুমুল সংগ্রাম ও সাহসের মধ্য দিয়ে হাদি হয়ে উঠলেন লাখো মানুষের অনুপ্রেরণা। সেই জুলাইয়ের সময়ের উজ্জ্বলতা আজও মানুষের মনে অম্লান।

সতীর্থরা ক্ষমতা, সমঝোতার খেলা খেললেও হাদির পথ একঘেঁয়ে ও দ্বিধাহীন ছিল। দলছুট হয়েও তিনি থেমে যাননি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা ও ছাত্র-জনতার দাবির ভিত্তিতে নিজেই প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ এক নতুন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক শক্তি, যা শুধুই শব্দ নয়, বাস্তব লড়াই ও ন্যায়বোধের প্রতীক।

মুখপাত্র হয়ে হাদি বারবার গর্জে উঠেছেন দুর্নীতি, দুঃশাসন, রাজনৈতিক আধিপত্য, বিদেশী হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। তার লড়াই ছিল নিঃসঙ্গ, দ্বিধাহীন এবং একটিই লক্ষ্য ন্যায় ও ইনসাফ। আওয়ামী লীগ, বড় তিনটি রাজনৈতিক দল, সবারই সমালোচনা করেছেন সমানভাবে। কোনো আপস তিনি জানতেন না। হাদির চোখে নতুন বাংলাদেশের ছবি স্পষ্ট ছিল নিরাপদ, স্বাধীন এবং মানুষের। প্রথম দিন থেকেই তাই তাকে হারানোর ভয়ে কাতর হয়েছিল শুভাকাঙ্ক্ষীরা।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাদি মানুষের দরজায় হাজির হন। মানুষের সঙ্গে হাঁটেন, কথা বলেন, তাদের আশা-ভরসার সঙ্গে মিলিত হন। নির্বাচনি খরচ জোগাতে মানুষের কাছে যেতেন, নিঃসঙ্কোচে। এই নিঃস্বার্থতা, এই সাহস তাকে মানুষের হৃদয়ের গভীরে অমোচনীয়ভাবে লিপ্ত করেছে।

শত হুমকি, শত্রুর ভয় কিছুই তার সাহস কমাতে পারেনি। বারবার বলেছেন, ‘বুলেট ছাড়া কেউ আমাকে থামাতে পারবে না।’ সত্যিই, সেই বুলেট তার মস্তিষ্ক ভেদ করে রক্ত ঝরিয়েছে বাংলাদেশের বুকের উপর। ঢাকা মেডিকেল থেকে এভারকেয়ার, এভারকেয়ার থেকে সিঙ্গাপুর এয়ার অ্যাম্বুলেন্সের সঙ্গে মিলেছে কোটি মানুষের প্রার্থনা। কিন্তু বীরের পথ শেষ হয়ে যায়, যখন সৃষ্টিকর্তার ডাক তাকে নেবার জন্য আসে।

মাথার খুলি এফোড়-ওফোড় হয়ে গেলেও মানুষের সীমাহীন ভালোবাসা হয়তো কিছুদিন তাকে এই ভুবনে আটকে রেখেছিল। আজও সেই ভালোবাসা বয়ে যায় প্রতিটি কণায় শরিফ ওসমান হাদির নাম, সাহস, প্রতিবাদ ও বিদ্রোহের সঙ্গে। তিনি কেবল একজন মানুষ ছিলেন না, তিনি এক আন্দোলন, এক প্রতীক, এক অমর কণ্ঠস্বর।

হাদির জীবন, তার সাহস, তার প্রতিবাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয় ন্যায় ও ইনসাফের লড়াই কখনো থামে না। তার বিদ্রোহী কণ্ঠ আজও আকাশে মিশে আছে, এবং তার অনুপ্রেরণা পাথেয় হয়ে আছে নতুন প্রজন্মের জন্য। শরিফ ওসমান হাদি-এক প্রতিবাদী জীবন, এক অমর নাম, এক অবিস্মরণীয় যাদু।

আরও পড়ুনবাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকাসন্ধ্যা নামলেই পুরোনো ইলেকট্রনিক্স পণ্যের হাট বসে যেখানে

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ, ঢাকা

কেএসকে