জাতীয়

অনিশ্চয়তায় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার

এক বছরের বেশি সময় ধরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ। এরই মধ্যে চলতি বছর দুই দফা ‘জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের’ বৈঠক হয়েছে। কিন্তু সিন্ডিকেট জটিলতায় শ্রমবাজার পুনরায় চালুর বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি দুই দেশ।

গত বছর অনুমতি পেয়েও ১৮ হাজার বাংলাদেশি কর্মী মালয়েশিয়া যেতে পারেনি। তাদের মধ্যে প্রথম ধাপে ৭ হাজার ৯২৬ কর্মী মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমতি পেলেও তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।

এরই মধ্যে শ্রমবাজার খোলার পথে নতুন সংকট তৈরি করেছে মালয়েশিয়ায় জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৩৬ বাংলাদেশিকে আটকের ঘটনা। ওই ঘটনাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে নতুন উদ্বেগ।

অভিবাসন বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের অভিযোগ কেবল নিরাপত্তা ইস্যু নয়, বরং এটি বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রতি আস্থা সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। অন্যদিকে এক বছরের বেশি সময়ে ধরে বন্ধ থাকা এ শ্রমবাজার উন্মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন বাংলাদেশি কর্মীদের মাল্টিপল এন্ট্রি ভিসা দেবে মালয়েশিয়া এক বছরে মালয়েশিয়া সর্বোচ্চ ৪০ হাজার কর্মী নেবে উপদেষ্টার আশ্বাসে আন্দোলন স্থগিত মালয়েশিয়া গমনেচ্ছুদের মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিসহ ৪৯৪ অভিবাসী আটক

মালয়েশিয়ায় পুনরায় শ্রমবাজার খোলা নিয়ে সে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে গুরুত্ব দিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে বৈধ উপায়ে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবারও উন্মুক্ত হয়।

অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনীর জাগো নিউজকে বলেন, মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার ব্যাপারে বিলম্ব হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ বিষয় নিয়ে যেটা করা যেতে পারে, সেটা হলো দুই দেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের মিটিং পুনরায় করা। যেন শ্রমবাজার পুনরায় উন্মুক্ত হতে বেশি বিলম্ব না হয়। এজন্য প্রো-অ্যাকটিভ ভূমিকা রাখতে হবে। উদ্যোগটা বাংলাদেশকে নিতে হবে।

তিনি বলেন, ‘যদি মালয়েশিয়া শ্রমবাজার খোলায় কোনো দীর্ঘসূত্রতা করে তাহলে দেশটিতে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছুক কর্মীদের পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) মাধ্যমে তাদের ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করা হবে, এই মর্মে মালয়েশিয়াকে আশ্বস্ত করতে হবে। পাশাপাশি এ ঘটনায় বাংলাদেশকেও তদন্ত করতে হবে। বাংলাদেশ চাইলে মালয়েশিয়া সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে সে দেশে এ বিষয়ে তদন্ত করুক, তাহলে কিছু বিশেষ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। তাহলে এটা আমাদের দেশের নিরাপত্তা ও শ্রমবাজারের জন্যও ভালো।’

আরও পড়ুন মালয়েশিয়ায় আটক ৩৬ বাংলাদেশির সবাই সন্ত্রাসবাদে জড়িত নয় মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশিদের পাসপোর্ট সেবা নিয়ে জরুরি বিজ্ঞপ্তি স্টাডি ইন মালয়েশিয়া এডুকেশন ফেয়ার শুরু ১৮ জুলাই বিমানবন্দর থেকে ৯৬ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠালো মালয়েশিয়া

গত ২৭ জুন মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাইফুদ্দিন নাসুশন ইসমাইল জঙ্গি সংগঠন আইএসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৩৬ বাংলাদেশিকে গ্রেফতারের বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, সেলাঙ্গর ও জোহর রাজ্যে গত ২৪ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া অভিযানে তিন ধাপে তাদের গ্রেফতার করা হয়।

এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে শাহ আলম ও জোহর বাহরু সেশন কোর্টে সন্ত্রাসবাদ-সম্পর্কিত অপরাধের জন্য অভিযোগ আনা হয়েছে। অন্য ১৫ জনের বিরুদ্ধে নির্বাসনের আদেশ জারি করা হয়েছে। বাকি ১৬ জনের বিরুদ্ধে আইএসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে অধিকতর তদন্ত চলছে।

মালয়েশিয়ার এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর শ্রমবাজারে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের প্রবেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে বলে মন্তব্য করেন অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রাম ওকাপের চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, বিদেশে যদি বাংলাদেশিদের এ ধরনের তৎপরতা ধরা পড়ে এটা নিঃসন্দেহে শ্রমবাজারের জন্য ক্ষতিকর। আশঙ্কাটা হলো এখন দেশটি বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নিতে দুবার ভাববে। তারা যদি ভাবে তাদের ঝুঁকি আছে, তাহলে তো তারা শ্রমিক নেবে না। ফলে এই শ্রমবাজারে অনিশ্চিত পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এবং উপসচিবকে ফোন দেওয়া হলেও তারা কল ধরেননি। কিংবা সরাসরি সাক্ষাৎ করলেও তারা মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আরও পড়ুন মালয়েশিয়ায় এক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে যৌন হেনস্তার অভিযোগ প্রবাসীদের সেবা নিশ্চিতে জোহর বাহরুতে চালু হচ্ছে কনস্যুলেট সম্মাননা পাওয়া ১৩তম বাংলাদেশি মালয়েশিয়া প্রবাসী নাসিম মিয়া রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উদ্যোগ স্বাগত জানালো আসিয়ান ৩৬ বাংলাদেশির সবাই সন্ত্রাসবাদে জড়িত নয়

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত ৮-১২ জুলাই মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিত এশিয়ান রিজিওনাল ফোরামের (এআরএফ) মিনিস্ট্রিয়াল মিটিংয়ে অংশ নিতে দেশটিতে সফর করেন। সফরকালে তিনি মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন এবং সেখানে মালয়েশিয়ায় আটক ৩৬ জন বাংলাদেশি নাগরিকের বিষয়টি উত্থাপন করেন।

দেশে ফিরে উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বুধবার (১৬ জুলাই) সাংবাদিকদের বলেন, বিষয়টি বাংলাদেশ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে এবং মালয়েশিয়া সরকারের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট যে, আটক ৩৬ জনের মধ্যে সবাই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

উপদেষ্টা বলেন, ‘মাত্র পাঁচজনের ক্ষেত্রে এমন অভিযোগ উঠেছে যাদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া সরকার তদন্ত করে কিছু প্রাথমিক প্রমাণ পেয়েছে এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার আওতায় নিয়েছে। বাকিদের মধ্যে কয়েকজনকে তারা বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়া বা মেয়াদের বেশি সময় ধরে থাকার মতো অভিবাসন নীতি ভঙ্গের কারণে। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে অন্য কোনো অভিযোগ নেই। থাকলে তারা তাদের রাখতো।’

তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘বাকিদের বিষয়ে তদন্ত চলছে। কয়েকজনকে দেশে ফেরত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মালয়েশিয়া সরকারকে অনুরোধ করেছি যে কোনো বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানোর আগে যেন আমাদের জানানো হয়। যাতে আমরা সেই ব্যক্তিদের বিষয়ে যাচাই-বাছাই করতে পারি। মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ ব্যাপারে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ে বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সচেতন এবং আন্তরিক। আমরা চাই, এ ধরনের সন্দেহ হলে দুদেশ তথ্য ভাগাভাগি করুক, যাতে যৌথভাবে তদন্ত করা সম্ভব হয়।’

আরও পড়ুন মালয়েশিয়ায় গ্রেফতার বাংলাদেশিদের নিয়ে যৌথ তদন্তে দুই দেশ শতবর্ষে আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির মোহাম্মদ বিদেশযাত্রার আগে চুক্তিপত্র পান না ৭৫ শতাংশ কর্মী: গবেষণা মালয়েশিয়া যেতে না পারা ৮১ শতাংশ কর্মী টাকা ফেরত পেয়েছেন সিন্ডিকেট ইস্যু ও দুদকের মামলা জটিলতা

মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে সরকার নির্ধারিত ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকার চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি অর্থ আদায় করে ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিদেশে পাচারের অভিযোগে ১২টি রিক্রুটিং এজেন্সির ৩২ জনের নামে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এরপর গত ২৩ এপ্রিল মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আজমান মোহাম্মদ ইউসুফ এক চিঠিতে বাংলাদেশ সরকারকে এসব অভিযোগ/মামলার বিষয়ে পর্যালোচনা ও প্রত্যাহারের আহ্বান জানান। কারণ এসব অভিযোগ তাদের আন্তর্জাতিক সুনাম, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ট্র্যাফিকিং ইন পারসন্স (টিআইপি)’ রিপোর্টে দেশের র‌্যাংকিং প্রভাবিত করতে পারে বলে মনে করছে মালয়েশিয়া।

প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সূত্র জাগো নিউজকে জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ প্রতিবেদনের পর মালয়েশিয়ায় সরকার কিছুটা চাপে রয়েছে। মালয়েশিয়া চায়, এসব মামলা যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয়ে যায়। তারা তো অফিসিয়ালি বলছে না। তাই মামলা তুলে নিলে এই কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে বলা মনে করা যায়।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সাবেক যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় জঙ্গি সন্দেহে যারা গ্রেফতার হচ্ছে এবং দেশে আসছে, তাদের বিষয়ে খুব ভালোভাবে তদন্ত হওয়া উচিত। যদি সত্যিকারই তারা অপরাধে যুক্ত থাকে তাহলে এটা কিন্তু একটা দেশের জন্য অ্যালার্মিং। শ্রমবাজারে এর খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোতেও এর নেগেটিভ ইমপ্যাক্ট থাকবে।

ফখরুল ইসলাম বলেন, শ্রমবাজার খুলতে দেরি হওয়ার আরেকটি কারণ সিন্ডিকেট ইস্যু। প্রবাসী কল্যাণ উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিস্ট হাসিনার আমলে মালয়েশিয়ার সঙ্গে যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) হয়েছে, এখানে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এখন এসব অনিয়ম জেনেও উনি এই এমওইউ কন্টিনিউ করবেন নাকি বাতিল করবেন সেটা উনার দায়িত্ব। আমরা বারবার দাবি জানিয়ে আসছি, নতুন এমওইউ করে সিন্ডিকেট ছাড়া লোক পাঠাতে। এ ইস্যুতে কয়েকটি এজেন্সির বিরুদ্ধে দুদকের মামলাও হয়েছে। এখন উপদেষ্টার দায়িত্ব আগের সরকারের নানান অনিয়মের বিষয়ে মালয়েশিয়া সরকারকে বোঝানো। নাহলে এভাবে চলতে থাকলে এ শ্রমবাজারটা আর খুলবে না।

আরও পড়ুন আইএসে জড়িত থাকার অভিযোগে মালয়েশিয়ায় ৩৬ বাংলাদেশি আটক মালয়েশিয়া শ্রমবাজার নিয়ে অপপ্রচার, হাই কমিশনের প্রতিবাদ মালয়েশিয়ায় জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা মালয়েশিয়ায় আটক ব্যক্তিরা জঙ্গি নয়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

২০২৪ সালে নতুন-পুরোনো বিদেশি কর্মীদের কাজে যোগ দেওয়ার জন্য ৩১ মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয় মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিমানের টিকিট স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে ওই সময়ের মধ্যে যেতে পারেননি প্রায় ১৮ হাজার বাংলাদেশি। এরপর থেকে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানো বন্ধ।

এর মধ্যে গত মে মাসে প্রবাসীকল্যাণ উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মালয়েশিয়া সফরকালে যেতে না পারা ৭ হাজার ৯২৬ জনকে নিতে দেশটি রাজি হয়েছে বলে নিশ্চিত করেন। এরপর গত ২১ ও ২২ মে মালয়েশিয়া সরকার বাংলাদেশ থেকে কোন প্রক্রিয়ায় এবার শ্রমিক নেবে সেটি নির্ধারণ করার জন্য ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে দুদিনের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়। তখন যে কোনো সময় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার পথে এগোয় দুই দেশ।

আরএএস/এমএমএআর/এমএফএ/এএসএম