ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা এবং তাদের সন্তানদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে এ পর্যন্ত এক ডজন মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে ছয়টি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এসব মামলার আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
এছাড়া শেখ পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুদক আরও কয়েকটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে দুর্নীতি বিরোধী সংস্থাটি সূত্রে জানা গেছে।
শেখ হাসিনা ছাড়াও এসব মামলার আসামিরা হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। এছাড়া শেখ রেহানার দেবর ও শেখ হাসিনার সাবেক নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়েছে।
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা-পুতুলসহ ১৬ জনের নামে মামলামিথ্যা তথ্যে ডব্লিউএইচওতে চাকরি, পুতুলের বিরুদ্ধে মামলাপুতুলের সূচনা ফাউন্ডেশনের কর অব্যাহতি সুবিধা বাতিলনিজেকে ‘অসহায়’ দেখিয়ে সরকারি প্লট বরাদ্দ নেন শেখ রেহানা
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার। সেদিন ভারতে পালিয়ে যান তিনি। তার পরিবারের অন্যরাও দেশের বাইরে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে ৬ মামলাপরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে চলতি বছরের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সাত সদস্যদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করে দুদক।
গত ১০ মার্চ অভিযোগপত্রের অনুমোদন দেয় দুদক। এরপর এপ্রিলে শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, রেহানার মেয়ে টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক ও ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন আদালত।
আরও পড়ুনহাসিনার প্লট বরাদ্দে দুর্নীতি মামলা বিচারের জন্য বদলির নির্দেশপুতুলকে অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাশেখ হাসিনাসহ ২৩ জনের হাজিরে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশহাসিনার সামরিক উপদেষ্টা তারিকের সাড়ে ৬ কোটি টাকা অবরুদ্ধের আদেশ
পূর্বাচলে প্লট নেওয়ার বিষয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় গত ১২ আগস্ট তার ফেসবুকে উল্লেখ করেন, ‘পূর্বাচল নিউ টাউন প্রকল্পে জমি বরাদ্দের বিষয়ে আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) যে তথাকথিত দুর্নীতির মামলা দায়ের করেছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, বানোয়াট এবং অবৈধ ইউনূস সরকারের রাজনৈতিক কূটচাল মাত্র। পূর্বাচল প্লট বরাদ্দের পুরো প্রক্রিয়ায় কোনও অনিয়ম করা হয়নি, এমনকি আমাদের কাউকে কোনো বিশেষ সুবিধাও দেওয়া হয়নি।’
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত ২৭ জুলাই রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। প্রায় ৬০ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচারের অভিযোগে গত ১৪ আগস্ট সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে মামলা দুদক।
পুতুলের বিরুদ্ধে ৪ মামলাপ্লট জালিয়াতির অভিযোগে মামলাসহ সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করেছে দুদক। বিশ্ব স্বাস্থ সংস্থার পরিচালক হতে বিএসএমএমইউতে শিক্ষকতার ভুয়া যোগ্যতা দেখান সায়মা ওয়াজেদ। এমন অভিযোগে গত ২০ মার্চ পুতুলের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
একই দিন পুতুল পরিচালিত সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে ব্যাংকের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) ফান্ডের প্রায় ৩৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা হয়। মামলায় এক্সিম ব্যাংক ও বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) সাবেক চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার ও পুতুলকে আসামি করা হয়।
সূচনা ফাউন্ডেশনের নামে টাকা আত্মসাৎ ও সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে গত ১ সেপ্টেম্বর পুতুলসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
এ বিষয়ে সজীব ওয়াজেদ জয় গত ২ সেপ্টেম্বর তার ফেসবুকে উল্লেখ করেন, ‘তথাকথিত পুর্বাচল দুর্নীতি মামলার মতো এই মামলাতেও দুদক আমার বোন ও তার প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির বিষয়ে কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি। তারা সন্দেহজনক লেনদেনের কথা বলে, কিন্তু তার দ্বারা কী বোঝানো হয়েছে সেটাই ব্যাখ্যা করতে পারেনি।’
আরও পড়ুনশেখ হাসিনা ও স্বজনদের বিরুদ্ধে পৃথক ৩ মামলায় আরও ৬ জনের সাক্ষ্য৪৪৮ কোটি টাকা আত্মসাৎ: পুতুলসহ ৩৫ জনের নামে মামলা করবে দুদকহাসিনাকন্যা পুতুলের ফ্ল্যাট জব্দের আদেশশেখ হাসিনা-পুতুলসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
টিউলিপের বিরুদ্ধে ২ মামলাক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে পূর্বাচলে প্লট নেওয়ার অভিযোগে টিউলিপের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। আর গত এপ্রিলে ঢাকার গুলশানের একটি প্লট অবৈধভাবে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়ে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডের কাছ থেকে ঘুষ হিসেবে একটি ফ্ল্যাট নেওয়ার অভিযোগে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।
তবে দুদকের অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে দাবি করেছেন টিউলিপের আইনজীবী। গত এপ্রিলে টিউলিপের আইনজীবী প্রতিষ্ঠান ‘স্টিফেনসন হারউড’-এর সিনিয়র পার্টনার পল থুয়েট দাবি করেন, অভিযোগের ব্যাপারে দুদকের পক্ষ থেকে টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। এসব মামলা এবং এ বিষয়ক খবরকে ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে হয়রানি’ করার অভিযোগ আনা হয়েছে।
তবে দুর্নীতির অভিযোগে যুক্তরাজ্যের এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে করা মামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয় বলে দাবি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনের। তিনি বলেছেন, এটি কাউকে ছোট করার জন্য করা মামলা নয়, বরং সুনির্দিষ্ট তথ্য ও প্রমাণের ভিত্তিতে মামলা করা হয়েছে।
তারেক সিদ্দিকির পরিবারের বিরুদ্ধে ৪ মামলাঅবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক সামরিক উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল তারিক আহমেদ সিদ্দিক, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের বিরুদ্ধে গত ১৭ এপ্রিল পৃথক চারটি মামলা করেছে দুদক।
এর আগে তিন বিমানবন্দরে চার প্রকল্পে ৮১২ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তারিক আহমেদ সিদ্দিকসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে গত ২৭ জানুয়ারি মামলা করে দুদক। গত বছরের ডিসেম্বরে তারিক সিদ্দিকির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
মামলা ও অনুসন্ধানকে দুদকের স্বাভাবিক কার্যক্রম উল্লেখ করে দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, আইন ও বিধি মেনে অনুসন্ধান কার্যক্রমগুলো পরিচালিত হয়ে থাকে। বিধি মেনেই শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে মামলাগুলো হয়েছে।
আরও পড়ুনপুতুলের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির আদেশশেখ পরিবারের বিরুদ্ধে চতুর্থ দিনে সাক্ষ্য দিলেন আরও ৪ জনহাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে রেড নোটিশ জারির পদক্ষেপ নিতে দুদকের চিঠিশেখ পরিবারকে প্লট দিতে গণভবন থেকে চিঠি দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে
শেখ পরিবারের বিরুদ্ধে আরও মামলা হবেঅবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে শেখ রেহানার স্বামী শফিক আহমেদ সিদ্দিকির নামে মামলা অনুমোদন করতে পারে দুদক। এছাড়া আওয়ামী লীগের গবেষণা শাখা সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশনের (সিআরআই) নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগে আরও একটি মামলা অনুমোদন করতে পারে দুদক। এই মামলায় আসামি হতে পারেন জয়, আজমিনা ও রাদওয়ান মুজিব ববি।
এছাড়া বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের নামে অর্থ লোপাটের অভিযোগে শেখ রেহানার বিরুদ্ধে আরও একটি মামলার অনুমোদন করতে পারে দুদক। দ্রুতই এসব মামলা অনুমোদন হবে বলে দুদকের একাধিক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ’অভিযোগগুলো নিয়ে অনুসন্ধানে দুদকের দল কাজ করছে। যেসব ক্ষেত্রে দেশের বাইরে থেকে অনেক তথ্যাদি সংগ্রহ করতে হয়; সেক্ষেত্রে অনেক জায়গায় এমএলআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট) পাঠিয়েছি।’
এসএম/এমএমএআর