ফিচার

বাংলায় সমবায় আন্দোলন কেন জরুরি ছিল

ড. ফোরকান আলী

সমবায় সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা এবং সমবায় আন্দোলনে গতিশীলতা আনতে প্রতি বছর নভেম্বর মাসের প্রথম শনিবার দিবসটি দেশব্যাপী উদযাপন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘সাম্য ও সমতায়, দেশ গড়বে সমবায়’। ১৯৯৫ সালে জাতিসংঘ সমবায় দিবসের স্বীকৃতি দেয়। দেশের আনাচে-কানাচে সমবায়ীরা নিজেদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি উন্নয়নমূলক কাজে ভূমিকা রাখছেন। সমবায় সংগঠনের ধারণা বিশ্বব্যাপি সমাদৃত। অর্থনৈতিক উন্নয়নে সমবায় একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবেই বিবেচিত হয়। আর্ন্তজাতিকভাবেই সমবায়ের নীতিমালার মধ্যে আছে একতা, সাম্য, সহযোগিতা, সততা, আস্থা ও বিশ্বাস, সেবা এবং গণতন্ত্র।

১৮৪৪ সালে যুক্তরাজ্যে প্রথম সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম সমবায় আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ লোক গ্রামে বাস করতো। কৃষিই ছিল জনগণের জীবিকার একমাত্র উপায়। ১৮৭৫ সালে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন জায়গায় কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। এ বিদ্রোহের মূলে ছিল কৃষি ঋণের অভাব, মহাজনী ঋণের চক্রবৃদ্ধি উচ্চ সুদের হার, কৃষকদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০১ সালে ইন্ডিয়ান ফেমিন কমিশনের সুপারিশে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করেন। কমিটির সুপারিশে ১৯০৪ সালে তদানীন্তন ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন ‘সমবায় ঋণদান সমিতি আইন, ১৯০৪’ জারি করেন। পরে তৎকালীন ভারত সরকার পুনরায় নতুন করে ‘সমবায় সমিতি আইন-১৯১২’ জারি করে।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর সমবায় আন্দোলনে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন ২৬ হাজারেরও বেশি সমবায় সমিতি ছিল। তখন এগুলোর অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। এগুলোর মধ্যে অধিকাংশ সমিতিই পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যে অবসায়নে দেওয়া হয়। সরকার ও সমবায়ীদের যৌথ উদ্যোগে ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সমবায় ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে সরকার সমবায় সমিতিগুলোর ঋণ কার্যক্রম পুনরায় চালু করার উদ্যোগ নেয়। গ্রামীণ সমিতিগুলোর পরিবর্তে প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতি গঠন করা হয়। এই ইউনিয়ন বহুমুখী সমবায় সমিতিগুলোর মাধ্যমে কৃষকদের তখন সার, বীজ, কীটনাশক, ডিজেল সরবরাহ করা হতো। রাসায়নিক সার ব্যবহারে সমিতিগুলো তখন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতো। আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ ব্যবস্থার প্রচলনে সমিতিগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৫৬ সালে ড. আখতার হামিদ খান প্রায়োগিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে পল্লী উন্নয়ন অ্যাকাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগে ১৯৬০ সালে কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় ‘দ্বি-স্তর সমবায় পদ্ধতি’র যাত্রা শুরু হয়। গ্রাম পর্যায়ে প্রাথমিক সমবায় সমিতি ও থানা পর্যায়ে কোতোয়ালি থানা সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ অ্যাসোসিয়েশন চালু করা হয়। ১৯৬৫ সালে ‘কুমিল্লা জেলা সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’ কুমিল্লা জেলার ২২টি থানায় চালু করা হয়। ১৯৬০ সালে সমবায় অধিদপ্তর থেকে মাসিক ‘সমবায়’ এবং ইংরেজি ষান্মাসিক ‘কো-অপারেশন’ পত্রিকার প্রকাশনা শুরু হয়। ১৯৬০ সালে ঢাকার গ্রিন রোডে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ স্থাপিত হয়। ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ইউনিয়ন আর্ন্তজাতিক মৈত্রী সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।

১৯৬২ সালে প্রথমবারের মতো ‘জাতীয় সমবায় নীতিমালা’ গৃহীত ও প্রচারিত হয়। ১৯৭১ সালে ‘সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচি’ চালুর মাধ্যমে কুমিল্লায় দ্বিস্তর সমবায় কার্যক্রম দেশব্যাপী প্রসারের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সমন্বিত পল্লী উন্নয়ন কর্মসূচির সদর দপ্তর ঢাকায় স্থাপন করে একজন নির্বাহী পরিচালকের অধীনে জেলা এবং উপজেলা পর্যায়ে বেশ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ করে প্রকল্পের কাজ শুরু করে। স্বাধীনতার পর সমবায়ের গুরুত্ব উপলব্ধি করে বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের ১৩(খ) অনুচ্ছেদে সমবায়কে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুধের চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে সমবায়ের ভিত্তিতে দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেড (মিল্কভিটা) প্রতিষ্ঠা করেন।

আরও পড়ুনসংসার চালানোর তাগিদ থেকে উদ্যোক্তা বগুড়ার কনকশেয়াই পিঠা বাগেরহাটের শীতকালীন ঐতিহ্য

১৯৭৫ সালে সমবায় বিভাগ যানবাহন ও পরিবহন সমবায় সমিতি গঠন করে। ফলে বাংলাদেশ গণপরিবহন চালক সমবায় সমিতি ও পরে বাংলাদেশ অটোরিকশা চালক সমবায় সমিতি গড়ে ওঠে। মহিলা উন্নয়ন কর্মসূচি গ্রহণে মহিলা সমবায় সমিতি গঠন করে। ১৯৮২ সালে সরকার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড গঠন ও তাকে একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা হয়। একই সালে সমবায় বিভাগ ‘বাংলাদেশ ট্রাক চালক সমবায় ফেডারেশন’ গঠন করে। ১৯৮৩ সালে সমবায় বিভাগের অধীনে ‘বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ হাউজিং ফেডারেশন’ গঠনের মাধ্যমে হাউজিং সমবায় সমিতি গঠনেরও ভূমিকা রাখে। ১৯৮৩ সালে দেশের ১৩টি বৃহত্তর জেলায় ‘পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প-২’-এর কার্যক্রম বিআরডিবির মাধ্যমে চালু করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিআরডিবি কর্তৃক ‘পল্লী দরিদ্র কর্মসূচি’ চালু করা হয়। এর আওতায় গ্রাম পর্যায়ে প্রথমে বিত্তহীন সমবায় সমিতি এবং পরে মহিলা বিত্তহীন সমবায় সমিতির কাজ শুরু করা হয়।

বাংলাদেশ সরকার ১৯৮৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর ১৯৪০ সালের পুরোনো বঙ্গীয় সমবায় আইন বাতিল করে ‘সমবায় সমিতি অধ্যাদেশ-১৯৮৪’ জারি করে, যা ১৪ জানুয়ারি ১৯৮৫ তারিখে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। একই সালে সরকার সমবায় বিভাগের চাকরি বিসিএস ক্যাডারে অর্ন্তভুক্ত করেন। ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ সমবায় কলেজ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে ২০ জানুয়ারি ‘সমবায় সমিতি নিয়মাবলি-১৯৮৭’ গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জারি করা হয়। এতে নির্বাচন সংক্রান্ত সমবায়ের নতুন বিধিমালাসহ অনেক বিধি প্রণয়ন ও সংশোধন করা হয়। ১৯৮৯ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো সমবায় নীতিমালা প্রবর্তন করা হয়।

সমবায় বিভাগের আটটি আঞ্চলিক সমবায় ‘ইনস্টিটিউট উন্নয়ন প্রকল্প’ ওই বছরই জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৯৮৯ সালে প্রণীত ‘সমবায় নীতিমালা-২০১২’, জাতীয় সমবায় নীতিমালা, ২০১৩ সালে সমবায় আইনকে অধিকতর সংশোধন করে সংশোধিত সমবায় আইন, ২০১৩ জারি করা হয়। এ সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় সমবায় আন্দোলন অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। কৃষি ও ভোগ্য পণ্য উৎপাদন ও বিপণন, মাছ চাষ, আখ চাষ, দুধ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিপণন, তাঁতশিল্প, হস্তশিল্প, মৃৎশিল্প, চামড়াশিল্প, যানবাহন, আবাসন, মৌ চাষসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সমবায় সমিতিগুলো বিচরণ করছে।

সমবায়গুলো দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তাদের উৎপাদিত পণ্য এখন বিদেশেও রপ্তানি করছে। দেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সেক্টরে সংগঠিত এসব সমিতির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় পৌনে দুই লাখ। দেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ এসব সমিতির সদস্যপদ গ্রহণ করে সমবায় আন্দোলনকে জোরদার করেছে। বর্তমানে সমবায় আন্দোলন দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আর্থসামাজিক উন্নয়নে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

লেখক: গবেষক ও সাবেক অধ্যক্ষ।

এসইউ/এএসএম