বহুল আলোচিত নরসিংদী-২ আসনের সাবেক এমপি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান ওরফে পোটনের দুর্নীতি অনুসন্ধানে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তার বিরুদ্ধে সরকারিভাবে আমদানি করা ৫৮২ কোটি টাকা মূল্যের ৭২ হাজার টন ইউরিয়া সার বন্দরে খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাতের অভিযোগ খতিয়ে দেখছে সংস্থাটি। অন্যদিকে সার আত্মসাতের অভিযোগ ওঠায় সাবেক এই এমপির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে সরকার।
দুর্নীতি অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে দুদক। আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে বিসিআইসিকে তথ্য-উপাত্ত দুদকে জমা দিতে বলা হয়েছে। গতকাল সোমবার (৩ এপ্রিল) দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সার আত্মসাৎকারী প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান (পোটন) সাবেক সংসদ সদস্য ও সার ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ ফার্টিলাইজার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএ) সভাপতি। তিনিই মূলত দেশে সারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন।
জানা যায়, পরিবহন ঠিকাদার প্রোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খান পোটন ২০২১-২২ অর্থবছরে বিসিআইসির আমদানি করা তিন লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছানোর জন্য গ্রহণ করেন। এর মধ্যে ৫৮২ কোটি টাকা মূল্যের ৭২ হাজার টন সার তিনি গুদামে না পৌঁছে দিয়ে আত্মসাৎ করেন। সার আত্মসাতের বিষয়ে হাইকোর্ট বিভাগ স্বপ্রণোদিত রুল ইস্যু করেন। ওই রুল আদেশের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নামে দুদক।
সংস্থাটির পরিচালক আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদ স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, ৫৮২ কোটি টাকার সার আত্মসাৎ নিয়ে গত ৫ জানুয়ারি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদন বিষয়ে গত ৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত রুল জারি করেন। দুর্নীতির এ অভিযোগ বিষয়ে আগামী ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান শেষ করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দুদককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
জানা গেছে, হাকোর্টের আদেশ পাওয়ার পর দুদক এ অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়। গত ২৯ মার্চ দুদকের উপ-পরিচালক মো. রফিকুজ্জামানকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান দল গঠন করা হয়। অনুসন্ধান দলের অন্য সদস্যরা হলেন- সহকারী পরিচালক মো. আশিকুর রহমান ও মো. আবুল কালাম আজাদ। সংস্থাটির পরিচালককে (অনুসন্ধান ও তদন্ত-১) টিমের তদারক কর্মকর্তা করা হয়।
দুদক গতকাল সোমবার (৩ এপ্রিল) পোটনের সার আত্মসাতের তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিসিআইসিতে চিঠি পাঠিয়েছে। দলের প্রধান উপ-পরিচালক মো. রফিকুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, পরিবহন ঠিকাদার পোটন ট্রেডার্সের মালিক কামরুল আশরাফ খানের বিরুদ্ধে ২০২১-২২ অর্থবছরে বিসিআইসি কর্তৃক আমদানি করা ৫৮২ কোটি টাকা মূল্যের ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে না পৌঁছে আত্মসাৎ করেন। এ ঘটনার সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বেশ কিছু রেকর্ডপত্র প্রয়োজন। এসব রেকর্ডপত্র আগামী ১২ এপ্রিলের মধ্যে দুদকে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।
পোটন ট্রেডার্সের গুদামে আমদানি করা সার মজুত আছে কি না যাচাই করতে ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর বিসিআইসি দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই দুই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, পোটন ট্রেডার্স গত বছরের অক্টোবরের শুরুতে জানিয়েছিল তাদের ৬টি গুদামে ৬৬ হাজার টন সার রয়েছে। তবে সরেজমিন তদন্তে গিয়ে গুদামে মাত্র ১ হাজার ৩০০ টন সার পাওয়া যায়। ওই সারও ব্যবহারের অনুপযোগী ছিল। ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৫ মে’র মধ্যে ওই সার খালাস হয়েছিল।
এদিকে চিঠিতে সার পরিবহনের জন্য বিসিআইসি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পোটন ট্রেডার্সের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিসহ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র চেয়েছে দুদক।
দুদক সূত্র জানায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সরকারের আমদানি করা তিন লাখ ৯৩ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার খালাসের পর সরকারি গুদামে পৌঁছে দিতে পোটন ট্রেডার্সের সঙ্গে চুক্তি করা হয়। বন্দর থেকে খালাসের পর ৭২ হাজার মেট্রিক টন সার গুদামে পৌঁছে না দিয়ে আত্মসাৎ করে পরিবহনের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স পোটন ট্রেডার্স। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয় ৫৮২ কোটি টাকা।
অভিযোগে বলা হয়, পোটন ট্রেডার্স যে সার আত্মসাৎ করেছে, তা উঠে এসেছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসির দুটি তদন্তে। সারগুলো খালাস হয়েছিল ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ১৫ মে’র মধ্যে। সার সরবরাহ না করার পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি বিসিআইসি। সর্বশেষ গত বছরের ২০ ডিসেম্বর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়ে নির্দেশনা চেয়ে বিসিআইসির পক্ষ থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়।
এসএম/এমকেআর/এমএস