রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতার এমবিবিএস সনদ পাওয়া নিয়ে তোলপাড়

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি রাজশাহী
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ পিএম, ২৪ জুলাই ২০২৫
শাহরিয়ার রহমান সিয়াম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলার দায়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার রহমান সিয়াম। তারপরও তিনি পেয়েছেন এমবিবিএস পাসের চূড়ান্ত সনদ।

বহিষ্কৃত হওয়ার পর হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শেষ না করেও কীভাবে সিয়াম সনদ পেয়েছেন, তা নিয়ে শুরু হয়েছে তোলপাড়। তবে এ ঘটনা তদন্তে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক আজিজুল হক আজাদকে প্রধানকে একটি কমিটি গঠন করেছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। চার কর্মদিবসের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

সিয়াম রামেকের ডেন্টাল অনুষদের ২৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। রামেক শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি) আইন অনুযায়ী, এক বছরের ইন্টার্নশিপের বাধ্যবাধকতা থাকলেও ছয় মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সিয়াম। গত ১৫ মে গোপনে সনদও উত্তোলন করেছেন তিনি।

বগুড়া সদরের নারুলী পশ্চিমপাড়া গ্রামের মাহফুজার রহমানের ছেলে শাহরিয়ার রহমান সিয়াম। রামেক শাখা ছাত্রলীগের সবশেষ কমিটিতে সহ-সভাপতি ছিলেন। শিক্ষার্থী নির্যাতন, র‌্যাগিং, চাঁদাবাজি ও মাদকদ্রব্য সেবনসহ নানা অভিযোগে গত বছরের ৩ নভেম্বর ছয় মাসের জন্য তার ইন্টার্নশিপ স্থগিত করা হয়। একইসঙ্গে হোস্টেল থেকেও আজীবন বহিষ্কার হন তিনি।

এর আগে, ২০২৪ সালের ৩ জানুয়ারি রামেকের শেষ পেশাগত বিডিএস পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করা হয়। এরপর ১৮ জানুয়ারি রামেক হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ শুরু করেন সিয়াম। তবে পাঁচ আগে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর আত্মগোপনে চলে যান। হিসেব অনুযায়ী, চলতি বছরের ২ মে তার ইন্টার্নশিপ স্থগিতের মেয়াদ শেষ হয়। তবে সহপাঠীরা বলছেন, ইন্টার্নশিপের মেয়াদ পূর্ণ না করলেও গত ১৫ মে তিনি সনদ উত্তোলন করেন।

সহপাঠীরা জানান, শাহরিয়ার রহমান সিয়াম ১৮ জানুয়ারি ইন্টার্নশিপে যুক্ত হন। এ হিসেবে ৫ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ছয় মাস ১৮ দিন প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। আরও পাঁচ মাস ১২ দিন প্রশিক্ষণের পর চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি তার ইন্টার্নশিপ শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু এর আগেই ৫ আগস্টের পর তিনি লাপাত্তা। পরে ৩ নভেম্বর থেকে ছয় মাসের জন্য ইন্টার্নশিপ স্থগিত হয় তার। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই চূড়ান্ত সনদ পাওয়ার সুযোগ নেই সিয়ামের। ৩ মে থেকে অন্তত আরও পাঁচ মাস ১২ দিন ইন্টার্নশিপের পরই এ সুযোগ পাবেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের ৬ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত অর্থোডন্টিক্স, ১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল (ওএমএস), ১৬ অক্টোবর থেকে ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত প্রস্থোডন্টিক্স এবং ৩০ নভেম্বর থেকে চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত হয়। এসব প্রশিক্ষণে সিয়ামের অংশগ্রহণ ছিল বলে ইন্টার্নশিপ সম্পন্ন করার সনদে সইও করেছেন বিভাগগুলোর প্রধানরা।

সনদটি চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত হয় গত ১১ মে। এতে সই করা বিভাগীয় প্রধানেরা হলেন অর্থোডন্টিকস বিভাগের ডা. আব্দুর রশিদ মন্ডল (পরে বদলি হয়েছেন), ওএমএস বিভাগের ডা. শরিফুল ইসলাম, প্রস্থোডন্টিকস বিভাগের ডা. জাকি আজম এবং কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের ডা. ইসমাইল হোসেন। সনদে এসব বিভাগের প্রশিক্ষণ গ্রহণের ক্ষেত্রে মন্তব্যের ঘরে ইংরেজিতে লেখা হয়েছে ‘এক্সিলেন্ট’।

তবে এ বিষয়ে কনজারভেটিভ ডেন্টিস্ট্রি বিভাগের ডা. ইসমাইল হোসেনের ভাষ্য, ‌‘আমারসহ সব বিভাগীয় প্রধানের সই জাল করে সনদ তৈরি করা হয়েছে। ইন্টার্নশিপের হাজিরা খাতাতেও সিয়ামের সই নেই। এরপরও সে কীভাবে সনদ পেলো তা নিয়ে আমাদেরও প্রশ্ন।’

শুধু তাই নয়, সিয়াম আবাসিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন বলেও উল্লেখ আছে এতে। ইংরেজিতে লেখা এ সনদপত্রে বলা হয়েছে, ‘তিনি ওয়ার্ড/বিভাগে রোগীদের পরিচর্যার জন্য মেডিকেল অফিসার, সহকারী রেজিস্ট্রার/ওয়ার্ডের মেডিকেল অফিসারের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন এবং ওয়ার্ড/বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তার প্রশিক্ষণকে ‘চমৎকার’ হিসেবে মূল্যায়ন করা হয়েছে।

হাসপাতালের নথিপত্রে দেখা গেছে, চূড়ান্ত সনদ দেওয়ার ক্ষেত্রে রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফ এম শামীম আহমদ, সহকারী পরিচালক ডা. মো. আবু তালেব, ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান ডা. আবুল হোসেন ও রামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খন্দকার মোহাম্মদ ফয়সাল আলমের সই রয়েছে।

তবে হাসপাতালের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মো. আবু তালেব জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এ ধরনের কথা শুনেছি। তবে জানা নেই। আর কমিটি গঠনের বিষয়টিও জানি না।’

জানতে চাইলে রামেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. খন্দকার মোহাম্মদ ফয়সাল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সিয়াম ছাত্র হিসেবে অনেক দিন আগে রামেক থেকে বের হয়ে চলে গেছে। আমি অধ্যক্ষের দায়িত্ব নিয়েছি আরও পরে। সে ইন্টার্নশিপ করেছে। এতে ওখানকার বিভাগীয় ও ইউনিট প্রধানেরা সই করেছেন। সেটা দেখে আমিও সই করেছি।’

এ বিষয়ে বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) রাত ৯টার দিকে রামেক হাসপাতালের ডেন্টাল ইউনিটের প্রধান ডা. আবুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এখন রোগী দেখা নিয়ে ব্যস্ত আছি। এ বিষয়ে কিছু জানি না।’

তবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. এফ এম শামীম আহমদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘তার লগবুক ক্লিয়ার আছে। সবকিছু ঠিক পাওয়া গেছে। এসবের ভিত্তিতে সই দেওয়া হয়েছে। তবে এটি খুবই বিরল ঘটনা। আমরা তদন্ত করে দেখছি। যদি এরকম কিছু হয়, তার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সাখাওয়াত হোসেন/এসআর

 

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।