জোয়ারেও বাঁধ ভাঙার আতঙ্কে থাকে উপকূলবাসী
দেশের দক্ষিণাঞ্চলে সারাবছরই চলে বাঁধ ভাঙা আর গড়ার খলা। নদীভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ করা হলেও খুলনা জেলার নদীর পাড়ের মানুষের আতঙ্ক এখন সেই বাঁধ। সামান্য জোয়ারের পানিতে এখন বাঁধ ভাঙনের ভয়ে থাকে উপকূলের জনপদ।
বিশেষ করে কয়রা, পাইকগাছা এবং দাকোপ অঞ্চল জুড়ে মানুষের মধ্যে বছর জুড়ে একটা আতঙ্ক থাকে। বৃষ্টির সঙ্গে জোয়ারের পানি বেড়ে গেলে উপকূলীয় এ অঞ্চলগুলোর নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষের মধ্যে নদীভাঙন আতঙ্ক তৈরি হয়। সাগরের উত্তাল ঢেউ এবং নদীর গতি বদলের ফলে এলাকাগুলোতে ভাঙনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা এলাকাবাসীর। অন্যদিকে দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করছে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংশ্লিষ্টরা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, কয়রা, পাইকগাছা, ডুমুরিয়া, বটিয়াঘাটা, ফুলতলা, দিঘলিয়া, রূপসা, দাকোপ ও বটিয়াঘাটা উপজেলা নিয়ে গঠিত খুলনা জেলা। নদীর ভাঙন ঠেকাতে জেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২৭টি পোল্ডার রয়েছে। এসব পোল্ডারের দৈর্ঘ্য মোট ১ হাজার ১৩ দশমিক ৯০ কিলোমিটার। যার মধ্যে ৬ দশমিক ৭৭১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ। পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর আওতায় রয়েছে ৯টি পোল্ডার। যার মোট দৈর্ঘ্য ২৯৯ দশমিক ০৬ কিলোমিটার। পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর আওতায় রয়েছে ১৮টি পোল্ডার। যার দৈর্ঘ্য ৭১৪ দশমিক ৮৪ কিলোমিটার। উপজেলাগুলোর মধ্যে দাকোপ, বটিয়াঘাটা, পাইকগাছা এবং কয়রায় প্রায় ৩০ কিলোমিটার অতি ঝুঁকিপূর্ণ দুর্বল বাঁধ রয়েছে। অন্যদিকে পাইকগাছা এবং কয়রায় নদী ভাঙনের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩ কিলোমিটার। বাকি তিনটি পোল্ডার জেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ করা হলেও বর্তমানে কেউই এ রক্ষণাবেক্ষণ করছে না।
আরও পড়ুন
মাঠের অভাবে বিপন্ন শৈশব
বজ্রপাতে মানুষ মরে হাওরে, যন্ত্র বসেছে সাবেক এমপির বাড়ির সামনে
কৃষিখাতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সুদূরপ্রসারী
আরও জানা যায়, উপজেলাগুলোতে বাঁধ মেরামত ও সংরক্ষণে ২০২০-২১ অর্থ বছরে প্রায় ৭১ লাখ টাকা, ২০২১-২২ অর্থ বছরে প্রায় ৩ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে প্রায় ৩ কোটি ৪৬ লাখ টাকা, ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৭ কোটি ৬৬ লাখ টাকা এবং ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে প্রায় সাড়ে দশ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের মধ্যে রয়েছে কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট সংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকা, কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকা, মহারাজপুর ইউনিয়নের কাশিয়াবাদ, মঠেরকোনা, মঠবাড়ি, দশহালিয়া এলাকা, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাটকাটা থেকে গণেশ মেম্বারের বাড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশিরহাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার এবং মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল এলাকা, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকা, পাইকগাছার আলমতলার হাট থেকে পাইকগাছা ব্রিজ পর্যন্ত এক কিলোমিটার বাঁধ, দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের কামিনীবাসিয়া গ্রামের ৪ ও ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকা, বটবুনিয়া এলাকা, সুতারখালী ও বাণীশান্তা ইউনিয়নের একাধিক পয়েন্ট।

দাকোপ উপজেলার তিলডাঙ্গা ইউনিয়নের স্থানীয় বাসিন্দা কুমারেশ সরকার বলেন, বটবুনিয়া বাজার মন্দিরের সামনে আবারো দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। নদীভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড মাঝে মাঝে ব্লক আর বালির বস্তা ফেলছে। কিন্তু এভাবে কাজ করে ভাঙন ঠেকানো সম্ভব না। একের পর এক বেড়িবাঁধ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু কোনো স্থায়ী পরিকল্পনা নেই। বালুর বস্তা আর জিও ব্যাগ দিয়ে সাময়িক ঠেকানো ছাড়া কিছু না। সবাই আতঙ্কে থাকে।
খুলনার কয়রায় কপোতাক্ষ নদের বেড়িবাঁধে ভাঙন নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা শাহরিয়ার ইসলাম বলেন, প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছিল। কিন্তু আবারো বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। একটু জোয়ারের পানি বাড়লেই বাঁধ ধসে যাচ্ছে। বাঁধ যাতে না ভাঙে, সেজন্য নদীর তীরে পাকা ব্লক দেওয়া দরকার। স্থায়ী দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া কোনো সমাধান নেই।
পাইকগাছার বাসিন্দা শামসুর রহমান বলেন, আমাদের মতো উপকূলবাসীর নদী নিয়ে চিন্তা আর আতঙ্কে দিন কাটে। জোয়ার হলেই নদী পাড়ের মানুষের রাতে আর ঘুম হয় না। বাঁধ থাকলেও এখন বাঁধ ভাঙনের আতঙ্কে দিন কাটে আমাদের। নদীভাঙন এবং বাঁধ ঠেকাতে হলে উন্নত মানের কাজ ও পরিকল্পনা ছাড়া উপায় নেই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের খুলনা শাখার সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট বাবুল হাওলাদার বলেন, নদীভাঙন একটি জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য দীর্ঘ পরিকল্পনার সঙ্গে স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন। পরিবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে এজন্য কাজ করতে হবে। সব সমস্যা নিয়ে গবেষণা করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।
খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আব্দুল করিম বলেন, আবহাওয়া অফিসের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে আমরা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের জনগণকে সতর্ক করি। এছাড়াও তাদের প্রয়োজন হলে আশ্রয়কেন্দ্রে স্থানান্তরের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়। সিপিপি ভলান্টিয়ারের মাধ্যমে এবং মাইকিং করে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের জনগণকে সতর্ক করা হয়। জেলা এবং উপজেলা সমন্বয় করে যেকোনো দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়।
খুলনা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুল আলম বলেন, দ্রুততম সময়ের মধ্যে স্থায়ী সমাধানের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধ সংস্কার কাজ শুরু হবে। এছাড়া বাঁধ নিয়ে কোনো সমস্যা হলে সঙ্গে সঙ্গে কাজ করা হচ্ছে।
এফএ/জিকেএস