রামেকে কর্মচারীদের দাপ্তরিক পোশাকে হরিলুট

সাখাওয়াত হোসেন
সাখাওয়াত হোসেন সাখাওয়াত হোসেন , জেলা প্রতিনিধি রাজশাহী
প্রকাশিত: ০৬:২৫ পিএম, ২১ অক্টোবর ২০২৫
ফাইল ছবি

• বরাদ্দের পোশাক-জুতা-মোজা-ছাতা পান না কর্মচারীরা
•  ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৯ টাকার পোশাকের হদিস নেই
• দাপ্তরিক পোশাক ছাড়াই অফিস করছেন কর্মচারীরা

সরকারি চাকরির ১৬ থেকে ২০তম গ্রেডের কর্মচারীদের দাপ্তরিক পোশাকসামগ্রী (লিভারেজ) বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় টাকা। নিয়ম অনুযায়ী সেই টাকার পোশাক কিনে কর্মচারীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। তবে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের (রামেক) কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দের দুই বছরের পোশাকের কোনো হদিস মিলছে না। কাগজে-কলেমে এসব পোশাক তারা বিতরণ দেখালেও বাস্তবে পাননি কর্মচারীরা। ফলে অফিসের নির্ধারিত পোশাক ছাড়াই অফিস করছেন তারা।

২০১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়, সরকার ১৬-২০তম গ্রেডের কর্মচারীরা জন্য প্রতি দুই বছরের জন্য এক সেট ফুল সাফারি পাবেন, যার মূল্য হবে আড়াই হাজার টাকা। হাফ সাফারির জন্যও আড়াই হাজার টাকা। প্রতি বছরের জন্য একজোড়া জুতা, যার মূল্য এক হাজার ৮০০ টাকা। মোজা এক বছরের জন্য দুই সেট ১৫০ টাকা। ছাতা এক বছরের জন্য একটি ৩০০ টাকা। পাশাপাশি ভি গলার ফুল সোয়েটার দুই বছরের জন্য একটি এক হাজার টাকা। হাফ সোয়েটার একটি ৬০০ টাকা।

নারী কর্মচারীর জন্য জর্জেট শাড়ি দুটি ও সুতি শাড়ি দুটি দুই বছরের জন্য বরাদ্দ পাঁচ হাজার টাকা। স্যান্ডেল দুই জোড়া এক বছরের জন্য এক হাজার ৮০০ টাকা। ছাতা একটি এক বছরের জন্য ৩০০ টাকা। একইভাবে শীতে নারীদের জন্য শাল বাবদ বরাদ্দ এক হাজার। পাশাপাশি রেইনকোট ও অন্যান্য বাবদ এক হাজার ৬০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজের তথ্যমতে, রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সরকারি নীতিমালা ভেঙে ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পরপর দুইবার টেন্ডারের মাধ্যমে ২৪ লাখ ৩২ হাজার ৭৭৯ টাকার পোশাক কেনা হয়েছে। এসব পোশাক সরবরাহ করেছে ডিসেন্ট টেইলার্স, মেসার্স নয়ন ট্রেডার্স ও নূর ট্রেডিং কোম্পানি নামের তিন প্রতিষ্ঠান। তবে কাগজে-কলমে এসব পোশাক স্টোর বুঝিয়ে পাওয়া, বিল পরিশোধ ও বিতরণ দেখানো হলেও বাস্তবে এসব পোশাক পাননি কর্মচারীরা।

কর্মচারীদের অভিযোগ, তারা নামমাত্র কিছু টাকা পেয়েছেন। তবে কোনো পোশাক দেয়নি। আবার ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে কিছুই দেওয়া হয়নি। শুধু পোশাক দেওয়া হবে বলে তাদের কাছে থেকে সই নেওয়া হয়েছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজর তথ্য বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ১২৫ জন কর্মচারীদের লিভারেজ দেওয়া হয়েছে। এদের মধ্যে তিনজন গাড়িচালক, পুরুষ কর্মী ১০২ জন ও নারী কর্মী ২০ জন। এছাড়া ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে লিভারেজ পেয়েছেন মোট ১১৯ জন। এদের মধ্যে গাড়িচালক তিনজন, পুরুষ কর্মী ৯৭ জন ও নারী কর্মী ১৯ জন। বাস্তবে কেউ-ই পোশাক পাননি।

সরেজমিনে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ ঘুরে দেখা গেছে, তাদের প্রতি দপ্তরের ১৬-২০ গ্রেডের সবাই যে যারমতো পোশাক পড়ে আছেন। অথচ সরকারি নিয়মে আছে, সরকারি পোশাকপ্রাপ্তরা নির্ধারিত পোশাক পরে আসবেন। তবে তাদের কেউ সেই পোশাকে আসেননি।

প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় রামেক অধ্যক্ষের গাড়িচালক আব্দুল হামিদের সঙ্গে। নির্ধারতি পোশাকের কথা বলতেই তিনি ক্ষিপ্ত হন। বলেন, ‘আপনাকে কেন বলবো?’

পোশাক পেয়েছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যান, লিখে দেন আমাদের কোনো পোশাক দেয়নি।’ অথচ স্টোরকিপারের কাছে থাকা বিতরণের তালিকায় দেখা যায়, তাকে তিনটি সাফারি সেট দেওয়া হয়েছে। অথচ নিয়মে আছে একটি।

আরও পড়ুন:
হাজার ছাড়িয়েছে সাপে কাটা রোগী, আতঙ্কের নাম ‘রাসেলস ভাইপার’
রামেকের ইন্টার্ন চিকিৎসক শ্রেয়ানের কাজে মুগ্ধ স্বাস্থ্য উপদেষ্টা
বিনামূল্যে ১৭ কোটি টাকার ওষুধ এনে প্রশংসার শীর্ষে রামেকের শীর্ষ
কাগজে বহিষ্কার বাস্তবে বহাল রামেক চিকিৎসকরা
ইন্টার্নশিপ না করে বেতনও তুলে নিয়েছেন সেই ছাত্রলীগ নেতা
রামেক হাসপাতালের আইসিইউ যেন আরেক সন্তান ডা. আবু হেনার

গাড়িচালক আব্দুল হামিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর একজন কর্মচারী বলেন, ‘আমাদের কোনো পোশাক দেয়নি। তাই আমরা নিজেদের পোশাকেই অফিসে আসি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মচারী জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০২৩ সালে আমাদের খুবই সামান্য কিছু টাকা দেওয়া হয়। তবে কোনো মালামাল দেয়নি। ধরেন, সব মিলিয়ে আমরা পাই ১০ হাজার টাকার মতো। কিন্তু আমাদের দেওয়া হয় দুই আড়াই হাজার।’

তিনি আরও বলেন, ‘২০২৪ সালে আমাদের কোনো পোশাক দেওয়া হয়নি। তবে আমাদের পোশাক দেবে বলে সই নিয়েছে। বাস্তবে কিছুই দেয়নি। প্রতিবছর তাও কিছু টাকা দেয়, এবার সেটাও দেয়নি। তারা কখনোই কোনো পোশাক কেনেন না। শুধু কাগজে দেখিয়ে টাকা তুলে নেন।’

কর্মচারীরা পোশাক না পেলেও স্টোরকিপারের ফাইলে পোশাক বিতরণ করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। তবে সেখানেও নিয়ম লঙ্ঘনের চিত্র দেখা গেছে। নিয়ম লঙ্ঘন করে একজন গাড়িচালককে তিন সেট সাফারি দেওয়া হয়েছে। আরেক কর্মচারীকেও একইভাবে দেওয়া হয়েছে তিন চার সেট করে।

এ বিষয়ে রামেকের স্টোরকিপার ফয়সাল হায়দার বলেন, ‘আমার কাজ বুঝে নেওয়া ও বিতরণ করা, আমি সেটি করেছি। আমার কাগজেও সেটি আছে। এর বেশি কিছু বলতে পারবো না।’

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নূর ট্রেডিংয়ের মালিক হুমায়ুন ফরিদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা মালামাল সরবরাহ করেছি। তবে কী মালামাল দিয়েছি সেটি মনে নেই। তবে মাল দিয়েছি। স্টোর সেটি বুঝে নিয়েছে। না হলে তো আমরা বিল পেতাম না।’

আরেক প্রতিষ্ঠান ডিসেন্ট টেইলার্সের মালিক এমদাদুল ইসলাম বলেন, ‘আমার লাইসেন্স কেউ দিয়ে থাকতে পারে। তবে মালামাল দিয়েছে বলে আমার জানা নেই। এমন কোনো কাজ আমরা করিনি। তারপরও কেউ করে থাকলে জেনে জানাতে পারবো।’ এরপর কয়েক দফা যোগাযোগ করা হলেও তিনি আর কোনো তথ্য জানাননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের সচিব তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা পোশাক বিতরণ করেছি। আমাদের কাছে তাদের (কর্মচারী) সই আছে।’

কর্মচারীরা পোশাকসামগ্রী পাননি বলে জানালে তিনি বলেন, ‘যে পায়নি বলছে তাকে আমার কাছে ধরে নিয়ে আসেন। আমরা বিতরণ করেছি। তবে সামগ্রী বিতরণের কোনো ছবি নেই, ভবিষ্যতে তুলে রাখবো।’

মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ফয়সাল আলম বলেন, ‘যে সময়ের বিষয়ে আমাকে বলছেন, সে সময় আমি এখানে ছিলাম না। তবে কর্মচারীদের সামগ্রী বিতরণের বিষয়ে কিছু অনিয়মের কথা আমিও শুনেছি। পরপর দুবছর লিভারেজ বিতরণ করা হয়েছে, সেটি অনিয়ম। কেননা নীতিমালায় এক বছর পরপর বলা হয়েছে।’

এ বিষয়ে তৎকালীন অধ্যক্ষ অধ্যাপক নওশাদ আলীর সঙ্গে মোবাইলফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। তিনি স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) নেতা। ৫ আগস্টের পর তাকে বদলি করা হয়। এরপর তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান না করে আত্মগোপনে আছেন। তাই তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।