বিদেশি কৃষি যন্ত্রের ভিড়ে আমিরের দেশি উদ্ভাবনের যাদু

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ১২:২৬ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫

বগুড়ার কাটনারপাড়ার একটি ছোট ওয়ার্কশপে বসে আধুনিক কৃষিযন্ত্রের অবিকল প্রতিলিপি থেকে শুরু করে নিজের নকশায় ৫০টির বেশি কৃষি প্রযুক্তি তৈরি করেছেন আমির হোসেন। বহু বছর ধরে তার বানানো যন্ত্র দেশের মাঠে-ঘাটে ছড়িয়ে পড়েছে। সস্তা যন্ত্রাংশ, সহজ মেরামত আর কম দামে নির্ভরযোগ্য যন্ত্র পাওয়ায় কৃষকরা বিদেশি ব্র্যান্ডের ব্যয়বহুল পণ্যগুলো এড়িয়ে যেতে পারছেন।

আমির হোসেনের কৃষি যান্ত্রিকীকরণের এ রূপান্তরের ফলে শুধু কৃষকের উৎপাদন ব্যয়ই কমেনি, দেশেও বছরে শত কোটি টাকার যন্ত্র আমদানি ব্যয় সাশ্রয় হচ্ছে। উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিতে দেশীয় প্রযুক্তির যে নতুন ধারা তৈরি হয়েছে, তার পেছনে অন্যতম বড় ভূমিকা রেখে চলেছেন এই স্বশিক্ষিত উদ্ভাবক।

কিশোর বয়সেই বাড়ির পাশের একটি গ্যারাজে কাজ শিখতে শুরু করেন আমির। প্রথম দিকে মোটরসাইকেল আর সেচ পাম্প মেরামত করতেন। ধীরে ধীরে বুঝলেন, কৃষকের মূল যন্ত্রপাতির সমস্যাগুলো বিদেশি মডেল দিয়ে পুরোপুরি মেটে না। মাঠের বাস্তবতার সঙ্গে এগুলোর নকশার মিল নেই। মেরামতের কাজ করতে করতে তিনি যন্ত্র ভেঙে দেখে শিখেছেন, আবার নতুন করে জোড়া দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছেন কোন অংশ কীভাবে কাজ করে। ঠিক সেই জায়গা থেকেই তার উদ্ভাবনের পথ শুরু। এখন দুটি জায়গায় কাজ চালান। মূল ওয়ার্কশপটি শহরের কাটনারপাড়ায়। আরেকটি রয়েছে শহরতলীর মাটিডালি এলাকায়।

কৃষকের চাহিদায় আধুনিক প্রযুক্তি

কাগজে-কলমে আমির হোসেন বিদেশি যন্ত্রের নকশা অনুসরণ করেন ঠিকই, কিন্তু তার কারখানায় তৈরি একটি যন্ত্রও হুবহু কপি নয়। কারণ মাঠে যে বাস্তব সমস্যার মুখোমুখি কৃষকরা হন, সেটার সঙ্গে বিদেশি নকশার মিল খুব কমই থাকে। বাংলাদেশে ছোট আকারের জমি, ভারী কাদা, শক্ত মাটি, দুর্বল ইঞ্জিন এবং সীমিত রক্ষণাবেক্ষণ সুবিধা এসব শর্ত বিদেশি মেশিন ডিজাইনের সময় বিবেচনায় থাকে না। আর সেই জায়গাটাতেই দাঁড়িয়ে আছে আমিরের কাজ।

তার ওয়ার্কশপে তৈরি হয় ধান কাটার মিনি-হার্ভেস্টার, ধান ঝাড়াই মেশিন, আলু তোলার ডিগার, মাল্টিকাল্টিভেটর, উন্নত রোটারি ঘাস কাটার মেশিন, সিডড্রিল, ভুট্টা ভাঙার যন্ত্র, রোটাভেটর, চাটাই মেশিন, ড্রাই মিক্সারসহ ৫০টির বেশি কৃষিযন্ত্র। প্রতিটির পেছনে থাকে মাঠ থেকে সংগ্রহ করা সমস্যা, কৃষকের অভিজ্ঞতা, আর বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী নকশা পরিবর্তনের প্রক্রিয়া।

বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কৃষক আবুল কালাম বলেন, বাজারে যে বিদেশি মিনি-হার্ভেস্টার আসে, তার ব্লেডের উচ্চতা দেশের কাদামাটির জন্য বেশি। ফলে ফসল কাটতে সমস্যা হয়। আমির সেই ব্লেডের উচ্চতা কমিয়ে দিলেন, চাকার গ্রিপ পাল্টালেন আর ইঞ্জিনের গিয়ারের অনুপাত এমনভাবে ঠিক করলেন যাতে কম শক্তির ইঞ্জিনেও যন্ত্র সহজে চলে। একইভাবে আলু ডিগারের দাঁড়া শক্ত করা হয়েছে যাতে শক্ত মাটিতেও আলুর ক্ষতি না হয়।

গাইবান্ধার কৃষক মনসুর আলী বলেন, আমার সমস্যার বিষয়টা জানালে আমির ব্লেডের কোণা পরিবর্তন করেন। শ্যাফটে শিল্ড বসান আর গিয়ারবক্সে নতুন সাপোর্ট যোগ করেন। কয়েক দিনের মধ্যেই মাঠের সমস্যা দূর হয়ে যায়।

বিদেশি কৃষি যন্ত্রের ভিড়ে আমিরের দেশি উদ্ভাবনের যাদু

ওয়ার্কশপের কর্মী মনির হোসেন বলেন, বিদেশি ডিজাইনে কৃষকের মাঠের সমস্যা নিয়ে ভাবা হয় না। কৃষকেরা যখন বলে কোন যন্ত্র কোথায় আটকে যাচ্ছে বা কোথায় ভেঙে যাচ্ছে, আমির ভাই সেটা রাতেই টেবিলে নিয়ে বসেন। পরদিনই তার ডিজাইনে পরিবর্তন আসে। রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টিও তিনি গুরুত্ব দেন। বিদেশি যন্ত্র নষ্ট হলে সার্ভিসিংয়ের খরচ অনেক বেশি। অনেক সময় যন্ত্রাংশ পাওয়া যায় না। কিন্তু আমির যন্ত্রের এমন নকশা করেছেন যাতে গ্রামের সাধারণ লোহার দোকানেও স্পেয়ার পার্টস তৈরি বা মেরামত করা যায়। এতে কৃষকের সময় ও খরচ দুটোই কমে। তার কিছু যন্ত্রে জ্বালানি খরচ ১৫-৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমে এসেছে গিয়ার অনুপাত ও ব্লেডের ঘূর্ণন সামঞ্জস্য করার কারণে।

কৃষি বিভাগের মাঠ কর্মকর্তা আমিরুল ইসলাম বলেন, আমির মাঠের চাহিদা থেকে ডিজাইন করেন। বিদেশি যন্ত্র কপি করলে হয়ত চেহারা মিলবে, কিন্তু কাজ মিলবে না। তিনি সেই কাজটাই মিলিয়ে দেন। যার কারণে মাঠের বাস্তব সমস্যার উপযোগী একটি দেশীয় প্রযুক্তি মডেল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ছে উত্তরাঞ্চলের গ্রামীণ কৃষি অর্থনীতিতে।

কোন যন্ত্রে কত সাশ্রয়

উত্তরাঞ্চলের কৃষি যন্ত্রের বাজার ঘুরলে সবচেয়ে দ্রুত যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হলো দাম। বিদেশি যন্ত্রের তুলনায় আমির হোসেনের তৈরি একই ক্ষমতার মেশিনের দাম তিন ভাগের এক ভাগও নয়। আর ঠিক এই দামের ব্যবধানই কৃষকের লাভের হিসাবকে বদলে দিয়েছে। স্থানীয় ডিলারদের তথ্য অনুযায়ী, বাজারে যে বিদেশি মিনি-হার্ভেস্টার পাওয়া যায় তার দাম গড়ে আড়াই লাখ থেকে ৩ লাখ টাকা। কিন্তু আমিরের তৈরি একই ক্ষমতার মেশিন পাওয়া যায় ৬০-৭০ হাজার টাকায়। এতে প্রতি যন্ত্রেই সাশ্রয় দাঁড়ায় প্রায় ২ লাখ টাকা।

কৃষকরা বলেন, কম দামে মেশিন কিনতে পারায় তারা হালকা জমিতেও সহজে ব্যবহার করতে পারছেন, আর নষ্ট হলেও সার্ভিসিংয়ের খরচ কম। বিদেশি আলু ডিগারের (আলু তোলার যন্ত্র) দাম ১ লাখ ২০ হাজার টাকা থেকে দেড় লাখ টাকা। অথচ আমিরের তৈরি মডেল ৩৫-৪০ হাজার টাকায় পাওয়া যায়। ফলে একটি যন্ত্রেই সাশ্রয় ৮০ হাজার টাকার বেশি।

রংপুরের আলুচাষিরা জানান, এই ডিগার শক্ত মাটিতে আলুর ক্ষতি কমায়, ফলে উৎপাদনও নষ্ট হয় না। বাজারে বিদেশি মাল্টি কাল্টিভেটরের দাম ১ লাখ টাকার ওপরে। আমিরের সংস্করণ ৩০-৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। এতে গড়ে ৬০ হাজার টাকার সাশ্রয় হয়। এই মেশিন দিয়ে একই সঙ্গে মাটি ভাঙা, আগাছা পরিষ্কার ও বীজতলা প্রস্তুত করা যায়। কৃষকের আলাদা যন্ত্র কেনার ঝামেলাও কমে।

অপরদিকে বিদেশি মডেলের ধান ঝাড়াই মেশিনের দাম ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার মধ্যে। আমিরের তৈরি সংস্করণের দাম মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকা। ফলে প্রতি ইউনিটে সাশ্রয় ৫০-৬০ হাজার টাকা। এটি হালকা কাঠামোর হওয়ায় সংকীর্ণ জায়গাতেও ব্যবহার করা যায়।

কৃষি বিভাগের তথ্য অনুসারে, বিগত ১০ বছরে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় মাঠে ব্যবহৃত আমিরের যন্ত্রের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। গড়ে প্রতিটি যন্ত্রে যদি ৩০ হাজার টাকার সাশ্রয় ধরা হয়, তাহলে কৃষকের বেঁচে গেছে ৬০ কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া যন্ত্রের স্পেয়ার পার্টস স্থানীয়ভাবে তৈরি হওয়ায় বছরে আরও ৩০ কোটি থেকে ৪০ কোটি টাকার বিদেশি পার্টস আমদানির খরচ বাঁচছে।

স্বীকৃতির সঙ্গে সীমাবদ্ধতা

গ্রামীণ উদ্ভাবক হিসেবে আমির হোসেনের স্বীকৃতি কম নয়। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন সংস্থা তাকে একাধিকবার সম্মাননা দিয়েছে। ২০০৮ ও ২০১১ সালে জাতীয় পর্যায়ের পুরস্কার পান তিনি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আমিরের তৈরি কয়েকটি মেশিন ধান ঝাড়াই যন্ত্র, মিনি-হার্ভেস্টার, ভুট্টা ভাঙা মেশিন ও জৈবসার মিক্সার মাঠপর্যায়ে পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করেছে।

তবে মাঠের রিপোর্টে সেসব যন্ত্রের কর্মক্ষমতা ভালো পাওয়া গেলেও এগুলো কখনোই বড় পরিসরে উৎপাদনের জন্য সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে গ্রহণ করা হয়নি। এর মূল কারণ হলো, আমিরের উৎপাদন কেন্দ্র এখনো একটি ছোট ওয়ার্কশপ। প্রতিদিন সীমিত সংখ্যক শ্রমিক, হাতে বানানো যন্ত্রাংশ আর প্রাথমিক সরঞ্জাম দিয়ে তিনি উৎপাদন চালান। মাসে বেশি হলে ৮-১০টি যন্ত্র তৈরিই সম্ভব হয়। বড় ফ্যাক্টরিতে রূপ দেওয়ার জন্য যে মেশিনারি, দক্ষ শ্রমশক্তি আর বিনিয়োগ দরকার তা তার নাগালের বাইরে। ফলে চাহিদা বাড়লেও উৎপাদন বাড়ানো যাচ্ছে না।

এছাড়া আমিরের বহু নকশা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে পেটেন্ট হয়নি। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এটিও বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠান তার নকশাকে বাণিজ্যিকভাবে বড় আকারে গ্রহণ করলে মালিকানা সংকটে পড়ার আশঙ্কা থাকে।

এ ব্যাপারে আমির হোসেন বলেন, আমি যা বানাই, কৃষক সেটা নিজের হাতে ব্যবহার করে। এটাই আমার সবচেয়ে বড় পাওয়া। কিন্তু বড় পরিসরে করতে পারলে সারাদেশে যন্ত্রের দাম অর্ধেক কমে যেত। দেশও বছরে কয়েক কোটি টাকা বাঁচাতে পারত। কিন্তু সরকারি সহযোগিতা না পেলে আমার পক্ষে তা করা সম্ভব নয়।

এফএ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।