শোকের মাঝেও বিধবাপল্লীতে সুখের ছোঁয়া
আজ ২৫ জুলাই, সোহাগপুর গণহত্যা দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর বেনুপাড়া গ্রামে পাকিস্তানি হায়েনার দল নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষকে নির্মমভাবে গুলি করে ও বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। সকল পুরুষ মানুষকে হত্যা করায় এ গ্রামের নাম হয় ‘বিধবাপল্লী’। সেদিন স্বজন হারানোদের গগণ বিদারী চিৎকারে সোহাগপুর গ্রামের আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। সোহাগপুর গণহত্যার ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসির রায় কার্যকর হয়েছে।
সোহাগপুর গণহত্যায় সম্ভ্রম হারানো বিধবাপল্লীর ১২ জন বীরঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়েছে সরকার। সোহাগপুরের বিধবাপল্লীতে বর্তমানে বেঁচে আছেন ২৪ জন বিধবা। স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ১২ জন বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা বিধবা হলেন- জোবেদা বেগম (৭৬), জোবেদা খাতুন (৭৪), আছিরন নেছা (৭৯), হাসেন ভানু (৬২), সমলা বেগম (৭২), হাফিজা বেগম (৬৮), মহিরণ বেওয়া (৭০), আছিরন নেছা (৬৯), জরিতন বেওয়া (৭২) (মরোনত্তর), হাসনে আরা বেগম (৬৫), হাজেরা খাতুন (৬৬) ও হাজেরা বেগম (৬৭)।
সোহাগপুরের বিধবাদের করুণ হাল দেখে সরকার তাদের ভাগ্যোন্নয়নে নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এ বিধবাপল্লীতে ২৯টি পরিবার থাকার জন্য ১টি করে পাকা ঘর পাচ্ছেন। প্রতিটি ঘরের নির্মাণ ব্যয় হচ্ছে ৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা করে। এছাড়া নিভৃতপল্লী সোহাগপুরে যাতায়াতে এক কিলোমিটার কাঁচা রাস্তাটিও পাকাকরণের কাজ চলছে। সরকার আর প্রশাসনের নজরে গ্রামটি এখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। শোকের মাঝেও যেন সুখের ছোঁয়া লেগেছে বিধবাপল্লীতে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উদ্যোগে ট্রাস্ট ব্যাংকের সিএসআর কার্যক্রমের আওতায় সোহাগপুরের বিধবারা এখন দুই হাজার টাকা করে মাসিক ভাতা পাচ্ছেন। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক মাসিক ৪শ’ টাকা হারে বিধবাদের ভাতা দিচ্ছেন। বিধবা ভাতা কিংবা বয়স্ক ভাতার আওতায় আনা হয়েছে এসব বিধবাদের। এছাড়া স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পাঁচশ টাকা করে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। পুলিশ সুপার কাজী আশরাফুল আজীম প্রধানমন্ত্রীর ত্রিশ লক্ষ শহীদের স্মরণে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির অংশ হিসেবে পুলিশের উদ্যোগে প্রত্যেক বিধবাদের বাড়িতে তিনটি করে উন্নত জাতের নারকেল গাছ রোপণ করে দিয়েছেন।
সোহাগপুর বিধবাপল্লীর বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধা হাফিজা বেগম (৬৮) বলেন, ‘বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ দেই। আগে আমরা বিনা আহারে (না খেয়ে) দিন কাডাইতাম। ওহন (এখন) বীরঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধার ভাতা পাইয়া নাতি-পুতি লইয়া ভালাই চলতাছি। সরকার আমগোরে থাহার লাইগা ঘর বানাইয়া দিছে। অহন আমরা সুখেই আছি।’
সদ্য মরণোত্তর বীরঙ্গনা স্বীকৃতপ্রাপ্ত জরিতন বেওয়ার ছেলে আজগর আলী বলেন, ‘গ্রামে সবই অইতাছে, কিন্তু শহীদগো কবর ও স্মৃতিসৌধ রক্ষা করার উদ্যোগ নেই।’

সোহাগপুর শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন (৫০) জানান, এক সময় বিধবাদের কষ্টে বুক ফেটে যেত, আজ সরকার প্রশাসনের নেক নজরে বিধবাপল্লী মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। এ জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।
তিনি আরও বলেন, স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সরকার বৃহত্তম ময়মনসিংহের কুখ্যাত আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর করায় আমরা শহীদ পরিবারের সদস্যরা খুশি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে শহীদ পরিবারের বিধবারা অনেক কষ্টে চলেছেন। এখন তারা একটু সুখের মুখ দেখছেন। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। পাশাপাশি দাবি করি, এ গ্রামে শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য একটি বিদ্যালয় এবং একটি স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠার। যাতে করে এ গ্রামে মানুষ এসে জানতে পারে মুক্তিযুদ্ধের সেই আত্মত্যাগের কাহিনী।
কাকরকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শহীদ উল্লাহ তালুকদার মুকুল বলেন, কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর কল্যাণে আমার ইউনিয়নে স্বাধীনতা যুদ্ধে নারকীয় হতাযজ্ঞের শিকার সোহাগপুর গ্রামের পরিচিতি এখন বিশ্বময়। দীর্ঘ সময় এঁরা প্রচুর কষ্ট করেছেন। এখন অনেক কিছুই পেয়েছেন। ৬২ জনের মধ্যে বেঁচে আছেন মাত্র ২৪ জন। তারাও এক সময় গত হবে। তাই তাদের আত্মত্যাগের স্মৃতিকে ধরে রাখতে একটা স্কুল এবং স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা করা হোক। যেখানে ঘর আলো করে বেড়ে উঠবে এ গ্রামের শিশুরা। সরকারের কাছে এমন দাবি জানাই।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় রাজাকার-আলবদররা শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে গণহত্যা চালিয়ে ১৮৭ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। এরপর থেকেই সোহাগপুর গ্রামটির নাম পাল্টে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ‘সোহাগপুর বিধবাপল্লী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। গণহত্যায় ৬২ জন নারী বিধবা হন।
তাদের মধ্যে নির্যাতনের শিকার ৬ নারীকে গত বছর সরকার ‘নারী মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি দিয়েছেন। সম্প্রতি আরও ৬ বিধবাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং বাকিদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিতে যাচাই-বাছাই চলছে।
বর্তমানে সোহাগপুরে বেঁচে আছেন শহীদ পরিবারের ২৪ জন বিধবা। গণহত্যায় এসব নারী স্বামী-স্বজন হারিয়েছেন এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারী আলবদর কমান্ডার জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম মুক্তিযুদ্ধ ’৭১ সোহাগপুর বিধবাপল্লীকে ‘সোহাগপুর বীরকন্যা পল্লী’ নামে ঘোষণা করেন।
হাকিম বাবুল/আরএস/পিআর