বান্দরবানে পাহাড় গ্রামগুলোর প্রবেশমুখ বন্ধ করে দিয়েছে ম্রোরা
বান্দরবান-চিম্বুক পাহাড়ের ম্রো গ্রামগুলোর প্রবেশমুখ এখন বাঁশের বেড়ায় বন্ধ। যাকে আমরা বলি লকডাউন। ম্রোদের ভাষায় একে বলে খাসুর। পাড়ায় কোনো মহামারি কিংবা দেশে বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ দেখা দিলে ম্রোরা পাড়ার প্রবেশমখে তৈরি করেন এই খাসুর বা বাঁশের বেড়া। দেশের কোরোনাভাইরাস এবং হামের আতঙ্কে এবার ম্রোরা তাদের নিজ এলাকায় তৈরি করেছেন এই খাসুর।
বান্দরবান চিম্বুক সড়কের ম্রোলংপাড়া, ম্রোপাড়া, বসন্ত পাড়া, ক্রামাদি পাড়া, রাংলাই চেয়ারম্যান, সিংচিংপাড়াসহ কমপক্ষে ২০টি পাড়ার ম্রোরা তৈরি করেছেন খাসুর।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বান্দরবান চিম্বুক সড়কের পাশে রাংলাই চেয়ারম্যানপাড়া ও ক্রামাদি পাড়া। এই পাড়ার প্রবেশ মুখ বাঁশ আর বেত দিয়ে বন্ধ করা। রাস্তার মাথায় বাঁশের বেড়া দিয়ে ম্রো ও বাংলা ভাষায় হাতের লেখা ব্যানারে 'করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বহিরাগত ব্যক্তিদের প্রবেশ নিষেধ' লিখে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও গ্রামের ভেতর থেকে কাউকে বাহির হতে দেয়াও হচ্ছে না।
আরও দেখা যায়, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা শুক্রবার বিকেলে পাড়াবন্ধ এলাকাগুলোর মানুষদের খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যান। কিন্তু পাড়ার প্রবেশমুখে খাসুর তৈরি করায় তাকেও ঢুকতে দেয়া হয়নি। পড়ে খাসুরের সামনেই গ্রামবাসীদের জন্য চাল, ডাল, লবণ রেখে যান।
বন্ধ বেড়ার অপর প্রান্ত থেকে রাংলাই চেয়াম্যান পাড়ার লেংপুং কারবারি জানান, দেশের রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রী যদিও আসে খাসুর তৈরির পরে আমরা পাড়ায় কাউকে ঢুকতে দেব না। এবার করোনাভাইরাস প্রতিরোধে এ খাসুর তৈরি করেছি।
রাংলাই চেয়ারম্যান পাড়ার বাসিন্দা কংনিং ম্রোলন বলেন, পাহাড়ে মহামারি দেখা দিলেই আমরা খাসুর তৈরি করি। এবারও করোনাভাইরাসের কারণে খাসুর তৈরি করেছি।
ম্রোদের সামাজিক রীতি-নীতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য সিয়ংইয়ং ম্রো জানান, পাহাড়ে কোনো মহামারি দেখা গেলেই ম্রোরা তৈরি করেন খাসুর, এটা তাদের ঐতিহ্য। খাসুর পেরিয়ে কেউ যদি নিয়ম লঙ্ঘন করে পাড়ায় ঢুকে পড়েন তাদেরকে চড়া সুদে জরিমানা দিতে হয় আর শাস্তি ভোগ করতে হয়।
বান্দরবানের নোয়া পাড়া, বসন্ত পাড়া, ক্রামাদি পাড়াসহ কমপক্ষে ২০টি পাড়ায় এই খাসুর তৈরি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
এদিকে, ম্রো সোস্যাল কাউন্সিলের সভাপতি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান রাংলাই ম্রো জানিয়েছেন, পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় চিম্বুক পাহাড় ও এখাকার ম্রো জনবসতিগুলো। এজন্য ওই পাড়াগুলোতে বাইরের লোকজন ঢোকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। করোনাভাইরাসের প্রকোপ না কমা পর্যন্ত এ রকম 'পাড়া লকডাউন' থাকবে। তবে পাড়াবাসীর দৈনন্দিন কাজকর্ম স্বাভাবিক থাকবে।
বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা জানান, ম্রোপাড়াগুলোতে যাতে কোনো ধরনের খাদ্য সংকট দেখা না দেয় সেজন্য আমি নিজে গিয়ে তাদেরকে খাদ্যদ্রব্য পৌঁছে দিচ্ছি। রাংলাই চেয়াম্যান পাড়া, ম্রোলং পাড়া, সিংচিংপাড়াসহ মোট ৭২টি পরিবারের প্রত্যেককে ১০ কেজি করে চাল, ডাল ও লবণ দেয়া হয়েছে। আর তাদের সুচিকিৎসার জন্য মেডিকেল টিম প্রস্তুত রেখেছি।
ম্রোভাষার লেখক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, করোনাভাইরাসের প্রচারপত্র ম্রোভাষায় অনুবাদ করে পাড়ায় পাড়ায় বিতরণ করা হয়েছে। এ জন্য পাড়াবাসী সচেতন হয়েছেন। এখন পাড়াগুলোতে বাইরের লোকজন কেউ ঢুকতে পারবেন না।
সৈকত দাশ/এমএএস/জেআইএম