মায়ের আর্তনাদ শুনলো না কেউ
শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ঘড়িসার ইউনিয়নের কলারগাঁও গ্রামের বাসিন্দা সুশান্ত কর্মকার (৩৪)। পা ফোলা, জ্বর, সর্দি ও শ্বাসকষ্ট নিয়ে শরীয়তপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি হন মঙ্গলবার দুপুরে। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে এমন সন্দেহে তাকে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়। বুধবার দুপুরে মারা যান ওই যুবক। বৃহস্পতিবার জানা যায় ওই যুবকের করোনা সংক্রমণ ছিল না।
ওই যুবক যে করোনায় আক্রান্ত ছিলেন না সিভিল সার্জন অফিসের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের চিকিৎসক মো. আবদুর রশিদ তা নিশ্চিত করেন।
কিন্তু মারা যাওয়ার পর তাকে শেষবারের মতো দেখতে আসা তো দূরের কথা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার জন্যও কেউ এগিয়ে আসেননি। ছেলের লাশের পাশে মা গঙ্গা রানি কর্মকার আর্তনাদ করে যাচ্ছিলেন আর ফোনে স্বজন, অন্য সন্তান আর গ্রামবাসীকে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করছিলেন। কিন্তু কেউ তার আর্তনাদে সাড়া দেয়নি। এমনকি সুশান্তর বড় ভাই, চার বোন ও বোনের পরিবারের সদস্যরাও ফিরে তাকাননি।
একপর্যায়ে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করা নিয়ে বিপাকে পড়েন মা গঙ্গা রানি ও স্থানীয় প্রশাসন। পরে শরীয়তপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক রাজন পাল উদ্যোগ নেন। তিনি ওই গ্রামবাসী ও ডিঙ্গামানিক শ্রীশ্রী সত্য নারায়ণের সেবা মন্দিরের কমিটি নিয়ে সভা করেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় মন্দিরের শ্মশানে ওই যুবককে দাহ করা হবে। কিন্তু দাহ করার কাজে যুক্ত হতে কেউ রাজি হচ্ছিলেন না। তখন রাজনের সঙ্গে যোগ দেন জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সহসভাপতি ত্রিনাথ ঘোষ, যুগ্ম সাধারণ সস্পাদক মিহির চক্রবর্তী, সদস্য দিলীপ ঘোষ, নড়িয়া উপজেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি চন্দন ব্যানার্জি।
তারা বৃহস্পতিবার সকালে ওই গ্রামবাসী ও যুবকের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু লাশের কাছে কেউ আসতে রাজি হননি। পরে পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ভেদরগঞ্জ উপজেলার দুই যুবক ও নড়িয়া উপজেলার তিন যুবক দাহ কাজ করতে রাজি হন। দুপুর পৌনে ১টার দিকে নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সে করে ছেলের লাশ নিয়ে ডিঙ্গামানিকে শ্রীশ্রী সত্য নারায়ণের সেবা মন্দিরে রওনা হন বৃদ্ধা গঙ্গা রানি।
গঙ্গা রানি বলেন, জীবনের শেষ বয়সে ছেলের লাশের ভার আমাকে এভাবে বইতে হবে তা ভাবতে পারিনি। এভাবে মানুষের মানবতা হারিয়ে গেল?
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়ন্তী রুপা রায় বলেন, করোনায় মৃত অথবা করোনা আক্রান্ত সন্দেহ আছে এমন মরদেহ বিশেষ সুরক্ষা মেনে সৎকার করতে হয়। আমরা সে অনুযায়ী পিপিই সরবরাহ করেছি। কিন্তু কাউকেই রাজি করাতে পারছিলাম না। পরবর্তীতে অন্য উপজেলার ও নড়িয়ার অন্য ইউনিয়নের যুবকরা এগিয়ে আসেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই যুবকের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজ শেষ করা হয়।
শরীয়তপুর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানিক ব্যানার্জি বলেন, যখন শুনতে পাই হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তির মরদেহ হাসপাতালে পড়ে আছে কেউ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় সহায়তা করছে না, তখন মনটা খারাপ হয়ে যায়। ঢাকায় অবস্থান করার কারণে আমি যেতে পারিনি। কিন্তু আমাদের স্থানীয় নেতাদের মাঠে নামিয়ে দিই। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ২১ ঘণ্টা পর তার লাশ হাসপাতাল থেকে এনে দাহ করা হয়।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা সন্দেহভাজন মৃত হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তিদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করার জন্য জেলার ছয় উপজেলায় কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য করা হয়েছে।
ছগির হোসেন/এফএ/জেআইএম