না পারছেন বলতে, না পারছেন সইতে
চলমান করোনা সংকটে মৌলভীবাজারে বেকার হয় পড়েছেন পর্যটন সংশ্লিষ্ট সাড়ে ৩ হাজার মানুষ। সেইসঙ্গে ঋণের জালে বন্দি হয়েছেন দেড় শতাধিক রিসোর্ট-কটেজের মালিক। এসব হোটেল-রিসোর্টের বেশিরভাগ কর্মকর্তা-কর্মচারিকে ছাঁটাই করা হলেও গণমাধ্যমে মুখ খুলছে না কেউ। মালিকপক্ষের নির্দেশে পরবর্তীতে চাকরি ফিরে পাওয়ার আশায় চুপ থাকলেও দিন কাটানো যেন অসম্ভব হয়ে পড়েছে কর্মহীন এসব মানুষের।
পর্যটন জেলা মৌলভীবাজারে তেমন কোনো শিল্পকারখানা নেই। হাওর বাওড় আর চাবাগান বেষ্টিত এই এলাকায় প্রধান শিল্প পর্যটন। প্রতি বছর লাখ লাখ পর্যটক আসেন এখানে। বর্ষা মৌসুমে সবুজ প্রকৃতি যখন আরও সবুজ ডানা মেলে তখন পর্যটকদের আকৃষ্ট করে এই সবুজ। হামহাম ও মাধবকুন্ড ঝর্ণা যেন যৌবন ফিরে পায় এ সময়। কিন্তু করোনার কারণে পর্যটক আসা বন্ধ থাকায় এরসঙ্গে সংশ্লিষ্ট সাড়ে ৩ হাজার মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে বিভিন্ন রিসোর্ট কটেজের ২৫০০ কর্মচারীর বড় একটি অংশ ছাঁটাই হয়েছেন।
পর্যটন সেবা সংস্থার শ্রীমঙ্গলের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক জানান, মৌলভীবাজার জেলায় মোট হোটেল রিসোর্ট প্রায় দেড়শ। এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন প্রায় ২৫০০ কর্মকর্তা কর্মচারী। এর বাইরে পর্যটকদের ঘিরে বিভিন্ন ব্যবসা যেমন পরিবহন গাইডসহ আনুমানিক আরও ১ হাজার মানুষ আছেন যাদের আয়ের প্রধান উপায় ছিল পর্যটন। কিন্তু বর্তমানে এদের বড় একটি অংশ বেকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কর্মচারীদের বড় একটি অংশ ছাঁটাই করা হয়েছে। বড় বড় প্রতিষ্ঠানে যেহেতু রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনবল প্রয়োজন হয় তাই তাদের কর্মচারীর একটি অংশ এখনও কাজ করলেও ছোট এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠান ছাঁটাই করেছে গণহারে। অনেক প্রতিষ্ঠান শুধু নিরাপত্তারক্ষীদের রেখে বাকি সবাইকে ছাঁটাই করেছে। যারা কাজ করছেন তাদেরকেও দেয়া হচ্ছে অর্ধেক বেতন।
ছাঁটাই হওয়া এসব কর্মচারীরা পড়েছেন মহাবিপদে। চাইলেও করোনা সংকটের কারণে অন্য কোনো কাজ পাচ্ছেন না। এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাদের একার আয়ে পরিবার চলত, তাদের অবস্থা বেশি শোচনীয়।
শ্রীমঙ্গলের একটি রিসোর্টে চাকরি করতেন আশরাফুল আলম। তিনি জানান, মালিক নিজের পকেট থেকে কত আর বেতন দেবে? তাই আমাদের ছাঁটাই করা হয়। আমরাও মেনে নিয়েছি কিন্তু পেটতো মানতে পারছে না। বর্তমানে বাড়িতে আছি, অভাবের সংসারে আমার যখন সাহায্য করার কথা ছিল তখন আমি তাদের দিকে চেয়ে আছি।
এদিকে ছাঁটাইয়ের বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে রাজি নয়। বিষয়টি এড়িয়ে যাচ্ছেন দায়িত্বশীলরা। ব্যক্তিগত আলাপে জানা গেছে কর্মকর্তা কর্মচারীদের একটি অংশ ছাঁটাই করা হয়েছে। আবার বেতন বন্ধ আছে বলে জানিয়েছেন একটি ৫ তারকা মানের রিসোর্টের কর্মকর্তা। তবে এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলতে মালিক পক্ষ থেকে নিষেধ করে দেয়া হয়েছে বলেও জানান তারা।
আরেকটি কারণে বেতন না পাওয়া এবং ছাঁটাইয়ের বিষয়টি নিয়ে নীরব আছেন কর্মচারীরা। তারা মনে করেন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তাদের প্রতিষ্ঠান তাদেরকে আবারও ডাকবে এবং অন্য প্রতিষ্ঠানে নতুন চাকরি নিতে গেলেও পূর্বের প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নপত্র লাগবে।
পাঁচ তারকা মানের হোটেল যেমন গ্র্যান্ড সুলতান ও দোসাইসহ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান হোটেল-রিসোর্ট বন্ধ থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় হাতেগোনা কর্মচারী রেখে বাকিদের বাড়িতে পাঠিয়েছে।
দোসাই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পার এইচআর মাহাবুব হোসেন জানান, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য যে কর্মচারী প্রয়োজন তারা ছাড়া সবাইকে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। আমাদের প্রায় ২০০ জনবল রয়েছে। কাউকে ছাঁটাই করা হয়নি আমরা সবাইকে বেতন দিয়ে যাচ্ছি। তবে সবাইকে পুরো বেতন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।
এদিকে একই প্রতিষ্ঠানের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলা নিষেধ আছে, আমি যতটা জানি বেশ কিছু কর্মচারীকে ছাঁটাই করা হয়ছে এবং অনেকের বেতন মার্চ থেকে বন্ধ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানের এইচআর বলেন, আমরা কাউকে ছাঁটাই করিনি।
গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ’র এজিএম আরমান খান বলেন, সবার মতো একই অবস্থা আমাদেরও। আমরা সরকারের প্রণোদনা পাওয়ার চেষ্টা করছি। কর্মচারীদের একটি অংশ বাড়িতে আছে তাদের বেতন দেয়া হচ্ছে। এর বেশি তথ্য গণমাধ্যমে আমরা দিতে চাচ্ছি না। তবে আমরা এখন ভর্তুকি দিয়ে প্রতিষ্ঠানের ব্যয় বহন করছি।
এই প্রতিষ্ঠানের সহকারী পাবলিক রিলেশন অফিসার শাহ আরিফ আলী নাসিম জানান, আমাদের প্রতিষ্ঠান মার্চের ২৬ তারিখ থেকে একেবারে বন্ধ। আমাদের ৪৫০ কর্মচারী রয়েছেন তবে সবার বেতন দেয়া হচ্ছে। তাদের বড় একটি অংশ বাড়িতে আছেন।
সব থেকে বেশি বিপদে পড়েছেন যারা লোন নিয়ে এবং ভাড়া ভবন নিয়ে হোটেল বা রিসোর্ট করেছেন তারা।
শ্রীমঙ্গলের হোটেল মেরিনার পরিচালক নাজমুল হাসান মিরাজ বলেন, এই হোটেলটি ভাড়া নিয়ে চালাই আমি। মাসিক ভাড়া এক লাখ ২০ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতনসহ মাসিক খরচ আড়াই লাখ টাকা। করোনার সঙ্কটে সব তছনছ। ঋণে জড়িয়ে পড়েছি।
‘এসকেডি আমার বাড়ি’ রিসোর্টের পরিচালক সজল দাশ বলেন, আমার ব্যাংক লোন আছে দুই কোটি ২০ লাখ টাকা। ১১ মার্চ থেকে আমার রিসোর্ট বন্ধ। কর্মচারীদের ছুটি দিয়েছি। কিন্তু তাদের বেতন তো দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিলের জন্যও চাপ আসছে, আছে ভুতুড়ে বিল। সবকিছু মিলিয়ে ঋণের জালে যেভাবে আটকে যাচ্ছি সরকারের সহযোগিতা ছাড়া বের হতে পারব না। পুঁজি হারানোর ভয়ে আছি আমরা।
টুরিজমের সঙ্গে জড়িয়ে আছে স্থানীয় ট্যুর গাইডদের জীবিকা। তারা ৩ মাস ধরে বেকার। লাউয়াছড়া ট্যুর গাইড অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক তাপস দাস জানান, কয়েকটি সংগঠন রয়েছে। শুধু আমাদের সংগঠনে আছেন ২০ জনের মতো যাদের পরিবার এই পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে সবাই মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে এবং বিকল্প আয়ের পথ খুঁজছে।
রিপন দে/এফএ/পিআর