‘জীবন্ত ঘড়ি’ মাগুরার অন্ধ নিখিল

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি মাগুরা
প্রকাশিত: ০৪:৫৬ পিএম, ০৩ ডিসেম্বর ২০২০

‘চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে। অন্তরে আজ দেখব যখন আলোক নাহি রে’-কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতোই বুকের ভেতরের গহীন দৃষ্টি দিয়েই যেন সবকিছু দেখতে পান অন্ধ নিখিল বিশ্বাস। তবে ‘নিখিল দা’ হিসেবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত। দিনের যে কোনো সময় ঠিক ঠিক সময় বলে দেয়ার কারণে জেলার অনেকেই তাকে জানেন ‘জীবন্ত ঘড়ি’ হিসেবে।

তার আরও একটি পরিচিতি আছে। তা হচ্ছে মান্না দে’র জনপ্রিয় বাংলা গান হুবহু পরিবেশনের কারণে। শহরের বিভিন্ন টি-স্টল আড্ডাখানায় যে কারণে তাকে প্রায়ই দেখা যায় এ ধরনের গানের আসর বসাতে। তার কণ্ঠে যখন অবিকল একই সুরে ‘তুমি অনেক যত্ন করে আমায় দুঃখ দিতে চেয়েছ/দিতে পারনি/ কী তার জবার দেবে/যদি বলি আমিই কি হেরেছি/ তুমিও কি একটুও হারো নি’ কিংবা ‘ললিতা গো/ ওকে আজ চলে যেতে বল না/ ও ঘাটে জল আনিতে যাব না যাব না’-এ ধরনের অসংখ্য জনপ্রিয় গানে শ্রোতারা মুগ্ধ না হয়ে পারেন না।

এই দুই কারণে মাগুরা শহরে নিখিল বিশ্বাসের রয়েছে অসংখ্য ভক্ত শুভানুধ্যায়ী। যে কোনো সময় তার কাছ থেকে শখ কিংবা খেয়ালেরবশে একটু সময় জেনে নেয়া কিংবা পুরোনো দিনের গান শোনা তাদের কাছে এখন অনেকটাই নেশার মতো হয়ে গেছে। তাকে দেখলেই সময় জানতে চান না এমন মানুষ খুবই কম। সেই সঙ্গে গান শোনার বিষয়টি তো রয়েছেই।

অন্যদিকে তার কাছ থেকে পাওয়া এই বিনোদনের বিনিময়ে সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা তুলে দিতে কার্পণ্য করেন না কেউই। ভালোবাসায় সিক্ত মানুষের যে সহায়তা নিয়ে নিখিল পার করে দিয়েছেন তার জীবনের ৫৮টি বছর।

নিখিল বিশ্বাসের বাড়ি সদর উপজেলার টেংগাখালী গ্রামে। মাত্র তিন বছর বয়সে বসন্ত রোগে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান। ছেলেবেলায়ই মাকে হারানোয় সৎমায়ের সংসারে অনাদর-অবহেলায় মানুষ হতে হয়েছে তাকে। এরপর যুবক বয়সেই অন্ধত্বকে পুঁজি করে মানুষের সাহায্যের প্রত্যাশায় বেরিয়ে পড়তে হয়েছে শহরের পথে।

নিখিল বিশ্বাস জানান, ভিক্ষাবৃত্তির প্রয়োজনে বাড়ি থেকে সকালে বেরিয়ে আবার সন্ধ্যার আগেই ফিরে যাওয়ার তাগিদ থাকে। এ কারণে প্রায়ই মানুষের কাছে সময় জিজ্ঞেস করতে হতো। এই সময় জেনে নেয়ার অভ্যাসটাই এক সময় তার ভেতরে অন্যরকম ক্ষমতা এনে দেয়। যে কারণে এখন জিজ্ঞেস না করেই আন্দাজ করে নিজেই বলে দিতে পারেন ঠিক ঠিক সময়।

১৮ বছর বয়সে তার সময় বলে দেয়ার বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর থেকে তাকে দেখলেই মানুষ সময় জানতে চান।

তিনি জানান, ছেলেবেলা থেকেই মান্না দের গান তার খুব ভালো লাগে। এ কারণে শুনতে শুনতে সেগুলো পুরোপুরি মুখস্থ হয়ে গেছে।

নিখিল বিশ্বাসের দেয়া তথ্যমতে, প্রতিদিন গ্রামের বাড়ি থেকে ৮ কিলোমিটার পথ হেঁটে তিনি শহরে আসেন। বাড়ি থেকে শহরে আসা আর শহর ঘুরে বাড়ি ফেরা পর্যন্ত মানুষের কাছে যে সহায়তা পান তা গড়ে প্রতিদিন ১৫০ থেকে ২০০ টাকায় দাঁড়ায়। সংসারে কেউ না থাকায় এই টাকা দিয়ে ভালোভাবেই চলে যায় তার।

শহরে ঘুরতে ঘুরতে প্রতিটি অলিগলি ও মানুষের কণ্ঠস্বর মুখস্থ হয়ে গেছে নিখিল বিশ্বাসের। যে কারণে শহরে পথচলা কিংবা মানুষ চেনার ব্যাপারে তার সমস্যা হয় না।

জীবনের বাকি দিনগুলো মানুষের ভালোবাসায় এভাবেই কাটাতে চান জীবন্ত ঘড়ি নিখিল বিশ্বাস।

আরাফাত হোসেন/এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।