মৌসুমি পতাকা বিক্রেতাদের জন্য হতাশার বছর ২০২০ সাল
২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহীদ দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস এবং ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় ও জাতীয় দিবস। রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে এ তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস পতাকা বিক্রেতাদের জন্য অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত সময়। মাসের শুরু থেকে নির্ধারিত দিন পর্যন্ত সারাদিনই বেচাকেনার ধুম লেগে থাকে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে।
গত ২৬ মার্চ থেকে করোনার ছোবলে সব ধরনের রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় মৌসুমি পতাকা বিক্রেতারা কাঙিক্ষত বিক্রির এক-তৃতীয়াংশও বিক্রি করতে পারেননি। ফলে হতাশ হয়েছেন তারা। এবার বিজয় দিবসে পতাকা ও পতাকা-সদৃশ ব্যান্ড, মাস্ক বিক্রি করতে না পারার হতাশায় বিক্রেতাদের মন খারাপ।
পতাকা বিক্রেতারা জানিয়েছেন, এবার বেচাকেনা নেই বললেই চলে। করোনা মহামারির কারণে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠান না হওয়া, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা এবং মানুষ কম বাইরে বের হওয়ায় পতাকা বিক্রির এ করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
১০ বছর ধরে পতাকা বিক্রি করেন সাইফুল ইসলাম। ঝালকাঠির শেখ রাসেল মিনি স্টেডিয়ামের সামনে বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) দুপুরে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বিজয় দিবসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার পতাকা বিক্রি করি। আজকে দুপুর পর্যন্ত ২০০ টাকাও বিক্রি করতে পারি নাই।’
তিনি বলেন, ‘স্কুল-কলেজ বন্ধ, করোনার কারণে মানুষ বাইরে বের হয় না। মাঠে বড় ধরনের অনুষ্ঠানও বন্ধ, পতাকা বিক্রি করব কার কাছে? এবার পতাকা, ব্যান্ড, পতাকা অঙ্কিত মাস্ক বেচাবিক্রি খুবই খারাপ। মাস্ক কিছুটা চলছে। অনুষ্ঠান না হলে বাইরে মানুষ বের হয় না। রাতে এবং ভোরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণের জন্য শিশুরা আসে না। শিশুরাই মূলত বেশি ছোট পতাকা, ব্যান্ড ও ক্রয় করে। মানুষ বাইরে বের না হলে শিশুরাও তো বের হয় না। তাহলে বিক্রি করব কার কাছে?’
আরেক পতাকা বিক্রেতা আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘এবার বেচাবিক্রির কথা বলে লাভ নাই ভাই। বহুদিন ধরে ব্যবসা করছি। ব্যবসার ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর এত কম বেচাবিক্রি আর কোনো সময় হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর বিজয় দিবসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার পতাকা বিক্রি করেছি। এবার ৪০০ টাকার বেশি হবে বলে মনে হয় না। আসলে মানুষের আনাগোনা নাই। করোনার কারণে মানুষ বাইরে আসে নাই।’

দোকানিরা জানিয়েছেন, ১০ টাকার কাঠি পতাকা থেকে সর্বোচ্চ এক হাজার টাকার পতাকা বিক্রি করেন তারা। একইসঙ্গে বিজয় দিবস লেখা ও বাংলাদেশের পতাকার আদলে তৈরি মাথা ও হাতের ব্যান্ডও বিক্রি করেন তারা। মাথা ও হাতের ব্যান্ডের দাম ১০ টাকা। কাগজের পতাকাও বিক্রি করেন তারা। কাগজের ১০০ পতাকার দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা।
এবার বিজয় দিবস লেখা ও বাংলাদেশ পতাকার আদলে তৈরি মাস্ক বিক্রি করতে দেখা গেছে। কাপড়ের তৈরি এসব মাস্কের প্রতিটির দাম রাখা হচ্ছে ২৫ টাকা।
পতাকা বিক্রেতা জিলু ব্যাপারীর বাড়ি পিরোজপুর জেলার সরূপকাঠি উপজেলায়। তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর পুরো ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও ডিসেম্বরের অর্ধেকটা সময় পতাকা বিক্রি করি। বাকি সময়টা সাংসারিক কাজে ব্যয় করি। নিজ বাড়ি, অফিশিয়াল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত বড় সাইজের প্রতিটি পতাকার মূল্য ৩০০ টাকা। বাসা, বাড়ি, ভবনে ব্যবহৃত মাঝারি সাইজের পতাকা ২০০ টাকা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ব্যবহারের জন্য ১৪০ টাকা, গাড়িতে ব্যবহারের জন্য ৬০ টাকা দরে বিক্রি করি। এছাড়া বিভিন্নভাবে ব্যবহারের জন্য ছোট ছোট একাধিক সাইজ রয়েছে। যার দাম ৪০, ৩০ ও ১০ টাকা।’
তিনি বলেন, ‘বুধবার (১৬ ডিসেম্বর) পতাকা বিক্রির যে অবস্থা তাতে দেখছি বের হওয়াটাই ভুল হয়েছে। বাইরে থাকা ও খাওয়ার খরচের পরে লাভ তো দূরের কথা, আরও লোকসান গুনতে হচ্ছে।’
মৌসুমি পতাকা বিক্রেতা হেমায়েত উদ্দিন (২৮) পেশায় একজন ফেরিওয়ালা। ফেরি করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করেই সংসার চলে তার। তিনি জানালেন, সারা বছর বিভিন্ন পণ্য ফেরি করে বিক্রি করলেও ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে তিনি ফেরি করে পতাকা বিক্রি করেন। রাতে পতাকা কিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে ফেরি করে পতাকা বিক্রি করেন।
তিনি জানান, তার কাছে পাওয়া যায় ১০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা মূল্যের পতাকা। ৪০০ টাকার পতাকার আকার বেশ বড় আর ১০ টাকার পতাকা কাগজের হাত পতাকা।
হেমায়েত জানান, প্রতিবছর দৈনিক ১৫শ থেকে ১৭শ টাকার পতাকা বিক্রি করেন। দাম নির্দিষ্ট না করে যার কাছ থেকে যেমন টাকা নেয়া যায় সে হিসেবে তিনি পতাকা বিক্রি করে থাকেন। আর এই মৌসুমি ব্যবসায় ভালোই লাভ হতো। এতে তিনি এক অন্যরকম তৃপ্তি পান বলে এই কাজ করেন দুই মৌসুমে। এ বছর তার তৃপ্তি বিষাদে পরিণত হয়েছে। পুঁজি ও শ্রম ব্যয় করে মোট হিসেবে লোকসানে ঘরে ফিরতে হচ্ছে বলে হতাশা প্রকাশ করেন হেমায়েত।
আতিকুর রহমান/এসআর/এমকেএইচ