বঙ্গবন্ধুর শৈশবের স্মৃতিধন্য যে বাড়ি

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গোপালগঞ্জ
প্রকাশিত: ০১:১৫ পিএম, ১৭ মার্চ ২০২১
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক বাড়ি

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার ছোট্ট খোকা। অজপাড়া গাঁয়ের গণ্ডি পেরিয়ে যিনি হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রিয় নেতা, মুক্তির আলোকবর্তিকা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মহানায়ক।

সেই মহানায়কের শৈশব-কৈশোর কেমন ছিল? কেমন ছিল তার বাল্যকালের স্কুল, খেলার মাঠ? কেমন ছিল বাড়ি? কোন বাড়িতে মহানায়কের জন্ম ও বেড়ে ওঠা? সেই গল্পই জানিয়েছেন মহানায়ককে কাছ থেকে দেখা টুঙ্গিপাড়ায় তার প্রতিবেশী ও স্বজনেরা।

টুঙ্গিপাড়ার এ বাড়ির আঙিনায় ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু তার খেলার সঙ্গীদের নিয়ে খেলেছেন। গ্রামের লোকদের সঙ্গে তিনি গোল্লাছুট, বুড়ির চি ইত্যাদি খেলেছেন। এমন বহু স্মৃতি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এ বাড়ির আঙিনায়

বিজ্ঞাপন

বহু বছর আগে শেখ বোরহান উদ্দিন নামে এক ধার্মিক পুরুষ টুঙ্গিপাড়ার মধুমতী নদীর তীরে শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেন। তারই বংশধর জমিদার শেখ কুদরত উল্লাহ মোগল আমলে একটি বাড়ি গড়ে তোলেন। ইতিহাস আর ঐতিহ্য মাথায় নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে সেই বাড়ি আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার এই বাড়ির একটি ঘরেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শৈশব থেকে শুরু করে জীবনের অনেকটা সময় তিনি কাটিয়েছেন এই বাড়িতে। বাবা শেখ লুৎফর রহমান ও মা শেখ সায়েরা খাতুন আদর করে ডাকতেন ‘খোকা’ বলে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইয়ে লিখেছেন, ‘আমার জন্ম হয় এই টুঙ্গিপাড়ায় শেখ বংশে। শেখ বোরহান উদ্দিন নামের এক ধার্মিক পুরুষ এই বংশের গোড়াপত্তন করেছেন বহুদিন পূর্বে। শেখ বংশের যে একদিন সুদিন ছিল তার প্রমাণস্বরূপ মোগল আমলের ছোট ছোট ইটের দ্বারা তৈরি চকমিলান দালানগুলি আজও আমাদের বাড়ির শ্রীবৃদ্ধি করে আছে। বাড়ির চার ভিটায় চারটা দালান। বাড়ির ভিতরে প্রবেশের একটামাত্র দরজা, যা আমরাও ছোট সময় দেখেছি বিরাট একটা কাঠের কপাট দিয়ে বন্ধ করা যেত। একটা দালানে আমার এক দাদা থাকতেন। এক দালানে আমার এক মামা আজও কোনোমতে দিন কাটাচ্ছে। আর একটা দালান ভেঙে পড়েছে। যেখানে বিষাক্ত সর্পকুল দয়া করে আশ্রয় নিয়েছে। এই সকল দালান চুনকাম করার ক্ষমতা আজ তাদের অনেকেরই নাই। এ বংশের অনেকেই এখন এই বাড়ির চারপাশে টিনের ঘরে বাস করেন। আমি এ টিনের ঘরের এক ঘরেই জম্মগ্রহণ করি। আমাদের বাড়ির দালানগুলো দুইশ’ বছরের বেশি হবে।’

Top.jpg

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য এ বাড়ি এখন আছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমাদের পূর্বপুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন, যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই দালানের ধ্বংসাবশেষ। ১৯৭১ সালে যে দুটো দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদাররা আগুন দিয়ে সে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়। এই দালানকোঠায় বসবাস শুরু হবার পর ধীরে ধীরে বংশ বৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এ দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চৌচালা ঘর তোলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমান এ বাড়িতেই সংসার গড়ে তোলেন। আর এখানেই ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জম্ম নেন আমার আব্বা (শেখ মুজিবুর রহমান)।’

বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে জিটি মাইনর স্কুল। প্রতিদিন পায়ে হেঁটে এ স্কুলে যাতায়াত করতেন লুৎফর-সায়েরা দম্পতির ছোট্ট ‘খোকা’। এ স্কুলে তার প্রিয় সহপাঠী মানিক, ছহিরুদ্দিন, গেদু মিয়া। তাদের সঙ্গে মিলে স্কুলের সব কাজের নেতৃত্বে থাকতেন খোকা।

জিটি স্কুল ঘিরে কত শত স্মৃতি কথা রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। স্কুলের ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের নিয়ে গাছে চড়ে আম পাড়তেন। নদীতে সাঁতার কেটে বড় হওয়া খোকা বাড়ির পাশে তালাবের মাঠে বিকেল হলে ফুটবল নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন। ফুটবল ও হাডুডু এবং ভলিবল খেলতে ভীষণ ভালোবাসতেন বঙ্গবন্ধু। রাজনীতির মতোই খেলার মাঠেও ছিল শেখ মুজিবের একছত্র আধিপত্য।

বিজ্ঞাপন

বিশেষ করে শারীরিকভাবে উচ্চতা বেশি হওয়ায় হেড দিয়ে গোল দিতে তিনি ছিলেন ভীষণ পারদর্শী। গ্রামীণ ঐতিহ্যের লাঠিখেলা দেখতে বঙ্গবন্ধু ভীষণ ভালোবাসতেন। এছাড়া খালের পানিতে হিজল গাছে চড়ে লাফ দিতেন কিশোর বঙ্গবন্ধু। এখনো সে গাছটি আছে। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি সংরক্ষণের অংশ হিসেবে গাছটিকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত বাড়িটি রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে। বাড়িটিকে পুরনো আদলে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে যাচ্ছে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভবনটি সংস্কার করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

শেখ বাড়ির সদস্য শেখ বোরহান উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, টুঙ্গিপাড়ার এ বাড়ির আঙিনায় ছোটবেলায় বঙ্গবন্ধু তার খেলার সঙ্গীদের নিয়ে খেলেছেন। গ্রামের লোকদের সঙ্গে তিনি গোল্লাছুট, বুড়ির চি ইত্যাদি খেলেছেন। এমন বহু স্মৃতি রয়েছে বঙ্গবন্ধুর এ বাড়ির আঙিনায়। রয়েছে তার সেই স্মৃতিময় স্থানগুলো।

বিজ্ঞাপন

Top.jpg

টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক বাড়ি

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিধন্য এ বাড়িটি দেখতে প্রতিনিয়ত ভিড় করেন দেশ-বিদেশের হাজারো দর্শনার্থী। বাড়িটির শৈল্পিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন তারা। এখানে এসে বাড়ির ইতিহাস, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন। অনেকে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিচারণ করেন তার স্কুলের সহপাঠী মো. আব্দুল হামিদ শেখ। বর্তমানে তার বয়স ১১১। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘মুজিব এই স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলত। দেহের গড়ন লম্বা হওয়ায় মাথা দিয়ে হেড দিত সে। মাথার বল কেউ নিতে পারত না। একবার ক্লাসের এক ছেলের গায়ে জামা না থাকায় বাড়ি যাবার পথে নিজের জামা খুলে দিয়ে যায় মুজিব। তার মতো উদার মনের মানুষ আমি জীবনে দেখিনি।’

বঙ্গবন্ধুর এই সহপাঠী আরও বলেন, ‘একবার এলাকায় ভীষণ অভাব। বাড়ির ধানের গোলা থেকে বাবার অলক্ষ্যে সবাইকে ধান দিয়েছিল মুজিব।’

বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে কাছের বন্ধু ছিলেন পাটগাতীর সৈয়দ নুরুল হক মানিক মিয়া। তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়েছেন। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মানিক মিয়ার কথা লিখেন, ‘মানিক আমার আবাল্য বন্ধু।’

বিজ্ঞাপন

মানিক মিয়ার ছেলে সৈয়দ বদরুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাবা মানিক মিয়া একবার টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। বঙ্গবন্ধু তখন প্রধানমন্ত্রী। নিরাপত্তাকর্মীরা তাকে ঢুকতে দিল না। বাবা অভিমানে ফিরে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধু দেখলেন তার বন্ধু মানিক হতাশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।’

‘এসময় বাবাকে নিয়ে যেতে নিরাপত্তাকর্মীদের বললেন বঙ্গবন্ধু। কাছে গিয়ে বাবা তখনো রেগে ছিলেন। রাগে রাগে বললেন, তোর কাছে আর আসব না। বঙ্গবন্ধু সব বুঝলেন। পাশে রাখা কাগজ টেনে তাতে গজগজ করে লিখে বন্ধু মানিকের হাতে দিলেন। তাতে লেখা, মানিক যখনই আসিবে তখনই দেখা করিবে- শেখ মুজিব।’

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

তার সহপাঠী-বন্ধুরা বলেন, বঙ্গবন্ধুর শৈশব কেটেছে গ্রামের আর দশজন শিশু-কিশোরের মতো। দলবেঁধে স্কুল, নদীতে সাঁতার, খেলার মাঠে দুরন্ত ছোটাছুটি সবই করেছেন তিনি। কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলী ও মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ, চেতনাগত আদর্শ তাকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে হয়ে ওঠেন বাঙালির মহানায়ক। মুজিব ভাই থেকে জাতির পিতা।

জেডএইচ/এইচএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন jagofeature@gmail.com ঠিকানায়।