মস্তিষ্কে মর্টার শেলের টুকরা নিয়ে বেঁচে আছেন ৫০ বছর
দেশ মাতৃকার টানে মুক্তিযুদ্ধে যাচ্ছেন স্বামী। আর তাকে বিদায় দিতে ঘরের বাইরে আসেন স্ত্রী নূরজাহান বেগম (৭০)। এসময় পাক-হানাদার বাহিনীর ছোড়া মর্টার শেলে আহত হন স্বামী-স্ত্রী দুজন।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার আমেদাবাদ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে । কিন্তু নূর-জাহানের মস্তিষ্কের ভেতরে রয়ে যায় মর্টার শেলের একটি টুকরো। সেই টুকরো নিয়ে গত ৫০ বছর ধরে বেঁচে আছেন তিনি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. নুরু মিয়া গত হয়েছেন। গত ১৫ দিন ধরে অসুস্থ নূরজাহান বেগম। শারীরিক বিভিন্ন সমস্যার কারণে নূর-জাহানের স্মৃতিশক্তি দ্রুত লোপ পেতে থাকে। মস্তিষ্কে মর্টার শেলের টুকরো থেকে যাওয়ায় সেখানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
তার চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি পোস্ট করেছেন কুলাউড়া উপজেলার বাসিন্দা ও সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মন ও স্নায়ুরোগ চিকিৎসক (সহকারী অধ্যাপক, সাইকিয়াট্রি বিভাগ ) ডা. সাঈদ এনাম।
২৪ এপ্রিল (শনিবার) বিকেলে কুলাউড়ার টিলাগাঁওয়ের লংলা খাস এলাকায় ওই নারীর বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা। বাড়িতে নেই নূরজাহান। চিকিৎসার জন্য ব্রাহ্মণ বাজার বড় ছেলের বাসায় অবস্থান করছেন। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। স্বজনদের দিকে তিনি নির্বাক হয়ে তাকিয়ে আছেন তিনি। তবে কারও সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন না। নূর-জাহানের মূল বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আমেদাবাদ এলাকায়। বর্তমানে তাদের পরিবার কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লংলা খাসের নতুন বস্তি এলাকায় বসবাস করছেন।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশমাতৃকার টানে নূর-জাহানের স্বামী নুরু মিয়া মুক্তিযুদ্ধে চলে যান। বাড়িতে ছিলেন স্ত্রী নূরজাহান বেগমসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। একপর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী সীমান্ত ঘেঁষা আমেদাবাদ এলাকায় হামলা চালায়। এ সময় মর্টার শেলের আঘাতে নূর-জাহানের বাবা আনছার আলী, ছোট ভাই নূর ইসলাম (১২), বোন জাহেরা খাতুন (১৬) ঘটনাস্থলেই মারা যান। এ ছাড়া মর্টার শেলের আঘাতে নূরজাহানসহ তার মা ফুলজান বেগম গুরুতর আহত হন। তার মস্তিষ্কে, বাম হাত ও বাম পায়ের উরুতে মর্টার শেলের আঘাত লাগে।
নূর-জাহানের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মো. নুরু মিয়া ২০১৯ সালের ২ জুন বার্ধক্যজনিত কারণে মারা যান। তার পরিবারে দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে সন্তান রয়েছেন। তার দুই ছেলে মোবারক হোসেন ও জালাল হোসেন সৌদি প্রবাসী। দুজনই বর্তমানে দেশে ছুটি কাটাতে এসেছেন।
নূর-জাহানের বড় ছেলে সৌদি প্রবাসী মোবারক হোসেন ও ছোট ছেলে জালাল হোসেন বলেন, যুদ্ধের পর আমাদের জন্ম হয়। ৩ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেন বাবা। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী তাদের এলাকায় নিরস্ত্র মানুষের ওপর হামলা চালায়। এসময় অনেক মানুষ হতাহত হন। তখন মায়ের শরীরের বিভিন্ন স্থানে মর্টার শেলের আঘাত লাগে। পরে তাকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়।
সেখানে ছয়মাস চিকিৎসা চলে। যুদ্ধ শেষে বাবা মাকে নিয়ে বাড়ি ফেরেন। তখন মায়ের চিকিৎসার যাবতীয় কাগজপত্র হারিয়ে যায়। কিন্তু তিনি আজও মুক্তিযোদ্ধার কোনো স্বীকৃতি পাননি।
তারা আরও বলেন, আখাউড়াতে ভিটে ছাড়া আর কিছু ছিল না। অভাব-অনটনে পড়ে যুদ্ধের পর বাবা সেই ভিটা বিক্রি করে দেন। ১৯৭৬ সালে বাবা কাজের সন্ধানে আমাদের নিয়ে কুলাউড়ায় চলে আসেন। ভূমিহীন হিসেবে উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের লংলা খাস এলাকায় আশ্রয় নেন। ১৯৯৭ সাল থেকে বাবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানী ভাতা পাওয়া শুরু করেন। জমানো ভাতাসহ আরও কিছু টাকা ধারদেনা করে আমাদের বিদেশে পাঠান। ২০১৫ সালে মোবারক কুলাউড়ার ব্রাহ্মণ বাজার ইউনিয়নের পশ্চিম গুড়াভুঁইয়ে কিছু জমি কিনে পাকা ঘর তোলেন। মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে ওঠেন।
তারা আরও বলেন, আঘাতের কারণে মা খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে চলাফেরা করতেন। এখন আর পারছেন না। এছাড়া এতদিন তার স্মৃতিশক্তি ভালোই ছিল। প্রায় সপ্তাহ দুয়েক আগ থেকেই হঠাৎ স্মৃতিশক্তি লোপ পেতে থাকে। এরপর চিকিৎসক সাঈদ এনামের চেম্বারে নিয়ে যাই। তার পরামর্শে সিলেটের ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করিয়ে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় বাড়িতে নিয়ে আসি।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি বিভাগ) ও আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক অ্যাসোসিয়শনের ফেলো ডা. মো. সাঈদ এনাম বলেন, আমার চেম্বারে নিয়ে আসার সময় নূর-জাহানের কিছুটা স্মৃতিশক্তি ছিল। অসুস্থতার ইতিহাস জানাতে গিয়ে অগোছালো ভাবে মুক্তিযুদ্ধকালে আহত হওয়ার বিশদ ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। মাথায় আঘাত পাওয়ার কথাও বলেন। যার প্রেক্ষিতে ওই নারীর মস্তিষ্ক এক্সরে করে তার মস্তিষ্কের ভেতরে মর্টার শেলের একটি টুকরোর অবস্থান দেখা যায়। এরকম ঘটনা অলৌকিক এবং বিস্ময়কর। গত ৫০ বছরে এই শেলের টুকরো তার মস্তিষ্কের প্রায় এক তৃতীয়াংশ গলিয়ে ফেলেছে।
তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে ‘পরেনসেফালি’। মস্তিষ্কের ভেতর মর্টার শেলের টুকরো নিয়ে ৫০ বছর বেঁচে থাকাটা সারা বিশ্বের চিকিৎসা বিজ্ঞানের জন্য বিরল ঘটনা।
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এটিএম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে চিকিৎসা সহায়তার জন্য জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কথা বলে উনাকে সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক মীর নাহিদ আহসান বলেন, বিষয়টি জানতে পারলাম। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে উনার চিকিৎসার বিষয়ে একটি লিখিত আবেদন করলে বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে আনব।
আব্দুল আজিজ/আরএইচ/জেআইএম