ভাঙচুরের পর বিধবার অবলম্বন সেলাই মেশিনটিও নিয়ে গেলো

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ১২:৩২ পিএম, ১৯ ডিসেম্বর ২০২১
ভাঙচুরে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি দেখাচ্ছেন বিধবা রাবেয়া খাতুন

‘আমার স্বামী-সন্তান মারা গেছে। আমি অসহায়। তারপরও ওরা আমার ঘর ভেঙে সব লুট করে নিয়ে গেছে। একটা সেলাই মেশিন দিয়ে সংসার চলতো, সেটিও নিয়ে গেছে ওরা। এখন আমি কী দিয়ে রোজগার করে খাবো আর কী দিয়েই বা ঘর মেরামত করবো জানি না। ঘরে কিছু টাকা ছিল। সেগুলোও রেখে যায়নি ওরা।’

এভাবেই নিজের ক্ষতিগ্রস্ত ঘর দেখাচ্ছিলেন আর কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার কৃষ্ণনগর মধ্যপাড়া গ্রামের স্বামী-সন্তান হারা রাবেয়া খাতুন।

শুক্রবার (১৭ ডিসেম্বর) রাত ১১টার দিকে আসন্ন পঞ্চম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের দ্বন্দের জেরে রাবেয়া খাতুনের বাড়িসহ ভাঙচুর করা হয় ওই এলাকার অন্তত ৩০টি বাড়ি। এসব বাড়ির মালামাল ভাঙচুরের পাশাপাশি নগদ টাকা, স্বর্ণালংকারসহ মালামাল লুটপাটেরও ঘটনা ঘটে।

চাষযোগ্য কোনো জমি নেই রাবেয়া খাতুনের। স্বামীর রেখে যাওয়া ছয় শতক জমিতে টিনশেডের দুই কক্ষের একটি ঘর রয়েছে। স্বামী প্রায় আট বছর আগে মারা যান। এর এক মাস পরে বড় সন্তান হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যায়। এরপর অনেক কষ্টে মেয়ের বিয়ে দেন। কিন্তু মেয়ের কপালেও সুখ জোটেনি। স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করায় তিনিও স্বামীর ঘর ছেড়ে মায়ের সঙ্গে থাকেন। ছোট ছেলে বিয়ে করে ঢাকায় থাকায়। মা-বোনের খোঁজ নেন না। এই অবস্থায় রাবেয়া খাতুনের উপার্জনের একমাত্র মাধ্যম ছিল সেলাই মেশিন। সেটিও নিয়ে গেছে তারা।

ভাঙচুরের পর বিধবার অবলম্বন সেলাই মেশিনটিও নিয়ে গেলো

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, শৈলকূপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসান মামুন ও বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার আলী কায়সার টিপুর সমর্থকদের মধ্যে কৃষ্ণনগর এলাকায় শুক্রবার সন্ধ্যায় ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেসময় অগ্নিসংযোগ করা হয় সাতটি মোটরসাইকেলে।

এরই জের ধরে রাত ১১টার দিকে বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার আলী কায়সার টিপুর সমর্থকরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের অন্তত ৩০টি বাড়ি ভাঙচুর করেন। এ ঘটনায় আহত হন অন্তত ১০ জন।

রাবেয়া খাতুনের মেয়ে সুমি খাতুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে আমার খোঁজখবর রাখতো না। এজন্য আমি বাড়িতে এসে মায়ের সঙ্গে থাকি। বাবা ও বড় ভাই মারা গেছেন। একটা ছোট ভাই আছে। সেও আমাদের খোঁজখবর তেমন একটা নেয় না। সেলাই মেশিনটি দিয়ে জামা-কাপড় সেলাই করেই আমাদের মা-মেয়ের সংসার চলতো কোনোরকমে।’

তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমাদের পরিবারে রাজনীতি, মিছিল, মিটিং করার মতো কেউ নেই। তাহলে নির্বাচনের মারামারিতে আমার বাড়ি কেন ভাঙচুর-লুটপাট করা হলো? এখন আমাদের কী হবে? কোথায় পাবো উপার্জনের সম্বল সেলাই মেশিন?’

ভাঙচুরের পর বিধবার অবলম্বন সেলাই মেশিনটিও নিয়ে গেলো

রাবেয়া খাতুনের প্রতিবেশীরা জানান, তাদের জায়গাজমি কিছুই নেই। সেলাই মেশিনের রোজগার দিয়েই সংসার চলতো। কিন্তু নির্বাচনের সহিংসতায় তারা সব হারিয়েছেন।

কৃষ্ণনগর গ্রামের গৃহবধূ শিরিন সুলতানার বাড়িতেও ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনা ঘটে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, “রাত আনুমানিক ১১টার দিকে বাড়ির দুইপাশ থেকে লোক এসে ঘরে ঢুকে দা, রামদা, লাঠি দিয়ে ভাঙচুর শুরু করে। এসময় ওরা বলতে থাকে ‘পেট্রোল ঢেলে সব জ্বালিয়ে দে’। কিন্তু তারা আগুন না ধরালেও আমার অনেক অলংকার ছিল, সেগুলো নিয়ে গেছে। তবে কারা এসেছিল আমি তাদের চিনতে পারিনি। এ ঘটনার পর থেকেই বাড়ি কোনো পুরুষ মানুষ নেই। আমরা খুবই ভয়ে আছি।”

সারুটিয়া ইউনিয়নের আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থী মাহমুদুল হাসান মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘মনোনয়নপত্র নিয়ে এলাকায় ফেরার পথে আমার কর্মী-সমর্থকদের ওপর প্রথম হামলা করে কয়েকটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এর কিছুদিন পর শুক্রবার রাতে আমার প্রতিপক্ষ চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার আলী কায়সার টিপু ও তার সমর্থকরা আমার সমর্থকদের ওপর হামলা করে মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। এরপর কৃষ্ণনগরসহ কয়েকটি এলাকায় বাড়িঘর ভাঙচুর করে। আগে মামলা করলে তাদের কয়েকজনকে আটক করে আদালতে পাঠায় পুলিশ। এর কয়েকদিন পরে জামিন পেয়ে এলাকায় ফিরে আবার তাণ্ডব শুরু করে। আমি প্রশাসনের কাছে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ দাবি করছি।’

হামলার বিষয়ে জানতে স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী) চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার আলী কায়সারের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেনি।

ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার (এসপি) মুনতাসিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ৪৪ জনকে আটক করা হয়েছে। যেহেতু শৈলকূপাসহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত বিশৃঙ্খলা ঘটছে সেজন্য খুলনাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ রিজার্ভ পুলিশ আনা হয়েছে।

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।