অযত্নে মোগল ঐতিহ্যের কবি কাদের নওয়াজের বাড়ি
বিখ্যাত ‘মা’ এবং ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ কবিতার কবি কাজী কাদের নওয়াজ। তার মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মুজদিয়া গ্রামের বাড়িটি অযত্ন ও অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। কবির শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু সংরক্ষণে নেই তেমন কোনো উদ্যোগ। তাই কবির বাড়িটি সংরক্ষণের জোর দাবি জানিয়েছে এলাকাবাসী।
বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান এ কবি ১৯০৯ সালের ১৫ জানুয়ারি অবিভক্ত বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলার তালিবপুর গ্রামে মাতুতালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গ ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন মোগল ঐতিহ্যের কবি কাজী কাদের নওয়াজ।

ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন। পরে দিনাজপুর জেলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি স্কুলে থেকে অবসর গ্রহণের পর থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার মহেশচন্দ্র পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি ইন্তেকালের পর শ্রীপুরের মুজদিয়ায় বাড়ির পাশেই কবির কবর দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কাজী কাদের নওয়াজ ১৯৪৮ সালে প্রখ্যাত হিন্দু জমিদার নগেন জোয়ার্দ্দারের সঙ্গে বিনিময় সূত্রে প্রাপ্ত প্রাসাদতুল্য দ্বিতল বাড়িতে আমৃত্যু স্থায়ীভাবে বসবাস করেন। কবির বসতভিটায় কালেরসাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরোনো সেই জমিদার বাড়ি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, অযত্ন ও অবহেলায় পড়ে আছে দ্বিতল বাড়িটি। গেট থাকলেও একাংশে বাউন্ডারি দেয়াল নেই। সংস্কার না করায় পুরোনো ভবনের ইট সুরকি ভেঙে পড়েছে। ভবনের ভেতরে কিছু কিছু অংশ ধসে গেছে। জানালা দরজা খুলে নিয়ে গেছে অনেক আগেই। ছাদসহ বিভিন্ন অংশে জমেছে আগাছা। ভাঙা অবস্থায় পড়ে আছে শৌচাগার। এলাকায় বসবাসকারী অনেকেই এ বাড়ির ছাদে গৃহস্থালি কাজও করছেন।
অভিযোগ আছে, রাতের বেলায় এখানে মানুষের আনাগোনা থাক। বসে মাদকের আসর। হয় মাদক বেচাকেনাও।

ভবন সংস্কার ও মিউজিয়াম তৈরি করলে কবির অনেক অজানা ইতিহাস জানতে পারবে নতুন প্রজন্ম। তাই শ্রীপুর তথা মাগুরাবাসীর দাবি দ্রুত সংস্কার ও সংরক্ষণ করে কবি কাজী কাদের নওয়াজের স্মৃতিবিজড়িত প্রাসাদটি পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা হোক।
মাগুরা থেকে ঘুরতে আসা জাহিদ বলেন, কবির বাড়িটি ঘুরে দেখলাম। মনে হলো এ জায়গাটা মাদকসেবীদের দখলে। তারা সারাক্ষণ এখানে আড্ডা দেয়। বাড়িটি সংরক্ষণ করে কবির স্মৃতি রক্ষা এবং সাধারণের জন্য দর্শনীয় স্থানে পরিণত করা উচিত।

সন্তানদের নিয়ে ঘুরতে আসা কলেজ শিক্ষিকা বলেন, ছোট বেলায় এ কবির কবিতা পড়েছি। বাচ্চাদেরও এ কবিতা শোনাই। তাই তাদের কবির বাড়ি দেখাতে এনেছি। এখানে এসে বাচ্চাদের অনেক প্রশ্নের উত্তরই দিতে পারিনি। এ বাড়িটি কবির জীবন সংশ্লিষ্ট সবকিছুর মধ্য দিয়ে সংরক্ষণ করা উচিত।
মায়ের সঙ্গে বেড়াতে আসা প্রথম শ্রেণিতে পড়ুয়া সিয়াম বলে, আমি এখানে খুব মজা করেছি, ক্রিকেট খেলেছি। কিন্তু এ জায়গাটা আমার কাছে খুব ভাঙাচুরা মনে হয়েছে। দোতলায় দেখলাম একটা বড় অংশ ভেঙে আছে। ওখানে যাওয়া রিস্ক। আমি আশা করেছিলাম এখানে এসে অনেক কিছু পাবো। কিন্তু কিছু পেলাম না।

কমলাপুর জিকে আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ মুসাফির নজরুল জাগো নিউজকে বলেন, মুঘল ঐতিহ্যের কবি কাদের নওয়াজ বাংলা সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক কালের একজন উল্লেখযোগ্য কবি। বিশেষ করে তার ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ এবং ‘মা‘ এ দুটি কবিতা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করতে অনেকাংশে অবদান রেখেছেন। কবির প্রাসাদের মতো বাড়িটি এখানে আছে। কবি কাদের নওয়াজ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে বাড়িটির অর্ধেকাংশ তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে লিখে নেওয়া হয়েছে। যা এখন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ দেখভাল করছে। সরকারের কাছে আহ্বান কবির আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে বাকি অংশটা নেওয়ার ব্যবস্থা করে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

বয়োবৃদ্ধ ছাদেক মিয়া বলেন, কবির এ বাড়ির সামনেই ছিল একটা কাচারি। উনি ওখানে বসে থাকতেন। আমরা রাস্তা দিয়ে গেলে আমাদের ডাক দিতেন। কবিতা শোনাতেন। কবির বাড়িটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক করলে মানুষ কবি সম্পর্কে আরও ধারণা পেতো।
এ বিষয়ে শ্রীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিউজা-উল-জান্নাহ জাগো নিউজকে বলেন, কবি কাদের নওয়াজের বাড়িটি উপজেলা প্রশাসন কার্যালয় থেকে বেশি দূরে নয়। আমি ওখানে গিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত ও ভঙ্গুর বাড়িটি নিয়ে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের একটি প্রস্তাবনা আছে। তারা এটিকে দর্শনীয় স্থানে রূপান্তর করলে বাড়িটি ফিরে পাবে তার জৌলুশ আর কবির সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অনেক কিছু জানতে পারবে।
এসজে/এমএস