ঝিনাইদহের সড়কে মৃত্যুর মিছিল, অবৈধ যান থামাবে কে?

আব্দুল্লাহ আল মাসুদ আব্দুল্লাহ আল মাসুদ ঝিনাইদহ
প্রকাশিত: ১১:০৮ এএম, ০১ মার্চ ২০২২

ট্রাফিক আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাব, অবৈধ যান, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালকের দাপটে ঝিনাইদহে আশংকাজনক হারে বেড়েছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই ছোট-বড় দুর্ঘটনায় দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিল। সড়ক-মহাসড়কগুলোতে নিষিদ্ধ তিন চাকার যানের অবাধ চলাচল, অন্যান্য যানবাহনের বেপরোয়া প্রতিযোগিতা আর চালকের অদক্ষতা এর মূল কারণ বলছে সচেতন মহল।

ঝিনাইদহ-ঢাকা মহাসড়ক কিংবা ঝিনাইদহ-যশোর, ঝিনাইদহ-চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ-কুষ্টিয়া প্রতিটি মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে প্রতিনিয়তই দ্রুত গতি আর একে অন্যকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে ছোট-বড় সকল যানবাহনের মধ্যে। আর এসকল কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনা।

জেলার বিভিন্ন সড়ক ঘুরে দেখা যায়, সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অবাধে চলাচল করছে আলমসাধু, নসিমন, করিমন, ভটভটি, ইজিবাইক ও ইঞ্জিনচালিত ভ্যান। শহর ও সড়কের যেখানে সেখানে দাঁড় করিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো করা হচ্ছে। সিগনাল না মেনে ছোটযানগুলো যত্রতত্র পার্শ্ববর্তী সড়ক থেকে উঠে পড়ছে মহাসড়কে। ফলে গতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হওয়াই দুর্ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছে।

অথচ ২০১৪ সাল ও এরপর থেকে কয়েক দফায় তিন চাকার যান মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ করা হয় হাইকোর্ট ও সরকারের বিভিন্ন মহল থেকে। তবুও সেই নিষিদ্ধাদেশ আজও বাস্তবায়ন হয়নি। এই তিন চাকার যানের পাশাপাশি বাস, ট্রাক, মোটরসাইকেলগুলোও চলছে বেপরোয়া গতিতে, চলছে ফিটনেসবিহীন গাড়ি। তাদের কারণে জরুরি উদ্ধারে নিয়োজিত দ্রুতগামী ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সকেও বেগ পেতে হয়।

ঝিনাইদহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে পাওয়া তথ্যে ২০১৭ সালে জেলায় ২৩৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন নিহত ও ৪৮৬ জন আহত হয়েছিলেন। ২০১৮ সালে ২৬৮ দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত ও ৫০২ জন আহত হয়। ২০১৯ সালে ১১২ দুর্ঘটনায় ১৮২ জন আহত এবং ১৪ জন নিহত হয়। ২০২০ সালে ২৫৮ দুর্ঘটনায় ৪০৯ জন আহত এবং ২১ জন নিহত হয়। ২০২১ সালে ২৮৯ দুর্ঘটনায় ৩৮৫ জন আহত এবং ৪১ জন নিহত হয়। এছাড়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১০৪টি দুর্ঘটনায় ১৭৬ জন আহত ও ১৩ জন নিহত হয়েছেন।

অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য মতে, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালগুলোতে ২০১৭ সালে চিকিৎসা নিয়েছেন ১৯৮৭ জন, ২০১৮ সালে ২২৫৫ জন, ২০১৯ সালে ৩০৮৯ জন, ২০২০ সালে ৩৭৪৫ জন এবং ২০২১ সালে ৪৭৩৮ জন ও ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২২৯ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

সব মিলিয়ে জেলায় ৫ বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১২৬ জন আর আহত হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন ১৭ হাজার ৩৮ জন।

ঝিনাইদহ-যশোর সড়কের লাউদিয়া এলাকার পথচারী শরিফুল ইসলাম বলেন, রাস্তার সাইড দিয়ে হাঁটা যায় না। ভয় লাগে কখন যেন গাড়ি চাপা দেয়। কারণ অত্যন্ত বেপরোয়া গতিতে গাড়িগুলো চলাচল করে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলে আলমসাধু, নসিমন, করিমন। রাস্তা যেন আমাদের কাছে একটা আতঙ্কের নাম।

অপর পথচারী শাহীন বিশ্বাস বলেন, যেখানে সেখানে ছোট গাড়িগুলো যাত্রী ওঠানো নামানো করছে, দাঁড়িয়ে থাকছে। এদের নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই। আমাদের সড়কগুলো অভিভাবকহীন। তাই বারবার আশ্বাস না দিয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উচিত কাজের বাস্তবায়ন করা, সড়কগুলো নিরাপদ করা।

শৈলকুপা এলাকার আলমসাধুর চালক ইমন জোয়ারদার বলেন, মহাসড়কে চলাচল নিষিদ্ধ জানি, আবার সব সিগনালও ঠিকমতো বুঝি না। কিন্তু রোজগারের আশায় আলমসাধু চালাই। সংসারতো চালাতে হবে। আমাদের খাবারতো কেউ দেয় না।

ঝিনাইদহের সড়কে মৃত্যুর মিছিল, অবৈধ যান থামাবে কে?

নসিমনচালক হামজা বিশ্বাস বলেন, মহাসড়কে ভাড়া বেশি পাওয়া যায়। গ্রামের একটি ভাড়া মারলে ৩০ থেকে ৪০ টাকা পাওয়া যায়, সেখানে গ্রাম থেকে একটি ভাড়া নিয়ে শহর এলাকায় এলে দুইশ টাকা পাওয়া যায়। তাই আসি। মাঝে মাঝে পুলিশ ধরে, মামলা দেয়। আবার কিছু ‘চা খরচ’ দিলে ছেড়েও দেয়। এভাবেই চলি সিস্টেম করে।

মেহেরপুর থেকে ঢাকাগামী পূর্বাশা পরিবহনের চালক শাহীন মিয়া জানান, আমরা ঠিকমতো সিগনাল দিয়ে সড়কে চলি। অনেক সময় আলমসাধু, নসিমনগুলো সিগনাল দেওয়ার পরও ইঞ্জিনের শব্দে তা শুনতে না পেয়ে বড় গাড়িকে সাইড দেয় না। আবার হুটহাট করে সাইড সড়ক থেকে মূল সড়কে উঠে গাড়িতে ধাক্কা দেয়। ফলে দুর্ঘটনা বেশি হয়।

ঝিনাইদহ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপ-সহকারী পরিচালক শামিমুল ইসলাম বলেন, মোট দুর্ঘটনার ৩০ থেকে ৪০ ভাগই ঘটে তিন চাকার যানের কারণে, ৪০ ভাগ মোটরসাইকেল আর বাকি ২০ ভাগ বড় যানবাহনের কারণে ঘটে থাকে। বিশেষ করে তাদের অদক্ষতা আর দ্রুত গতি এর অন্যতম কারণ। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা গেলে কমে আসবে দুর্ঘটনা। সঙ্গে চালকদেরকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বরত বাহিনীকেও এ ব্যাপারে যথেষ্ট দায়িত্বশীল হতে হবে।

ঝিনাইদহ ট্রাফিক ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন জানান, মহাসড়কে অবৈধ যানবাহন চলাচল বন্ধে ও গতি নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত পুলিশের অভিযান চলছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার পাশাপাশি চালকদের সতর্কতা অবলম্বনের জন্য সচেতনতামূলক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।