ইউপি চেয়ারম্যান সাংবাদিককে বললেন, ‘আইও, তোমারেও চাঁদা দিমুনে’

লিপসন আহমেদ লিপসন আহমেদ , সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৯:১৫ এএম, ০৯ মার্চ ২০২২
সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার নেতৃত্বে নৌপথে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ইনসেটে চেয়ারম্যান

সুনামগঞ্জের সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার নেতৃত্বে নৌপথে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। নিরুপায় হয়ে ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে দূর-দূরান্ত থেকে নৌকা, ট্রলার, কার্গো, বাল্কহেড নিয়ে আসা নৌশ্রমিকদের। শুধু তাই নয়, চাঁদা না দিলে নির্যাতন এমনকী টাকার বদলে মোবাইল ফোনসহ নৌকায় থাকা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ।

নৌশ্রমিকদের অভিযোগ, গত তিনমাস ধরে সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের হালুয়ার ঘাট, বিরামপুর, মঈনপুর—এ তিনটি জায়গা থেকে সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে এবং কোনো ধরনের ইজারা ছাড়া প্রতিদিন পাড়ে থাকা ৩০ থেকে ৩৫টি ছোট-বড় নৌকা, কার্গো, ট্রলার, বাল্কহেড থেকে চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চাঁদা তোলা হচ্ছে। যারা চাঁদা দিতে অস্বীকার করছেন তাদের চড়-থাপ্পড় মেরে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে। সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন কিংবা নৌযানে থাকা গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে চাঁদাবাজরা চলে যান।

সরেজমিন সুরমা ইউনিয়নের হালুয়ার ঘাট, বিরামপুর ও মঈনপুর নদীর পাড়ে গিয়ে দেখা যায়, চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজার নেতৃত্বে জাহিদুর, শিপনসহ ১০ জন যুবক এই তিন পয়েন্টে এবং নদীর পাড়ে থাকা ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রলার, কার্গো ও বাল্কহেডে গিয়ে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা দাবি করছেন। প্রাণের ভয়ে তাদের কথামতো ন্যূনতম এক হাজার টাকা দিলেও তারা সুরমা ইউনিয়নের রসিদে ৫০০ টাকা লিখে দিচ্ছেন আদায়কারীরা। শুধু তাই নয়, নীল রঙের ওই রসিদে সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের সিল নেই।

ইউপি চেয়ারম্যান সাংবাদিককে বললেন, ‘আইও, তুমারেও চাঁদাও দিমুনে’

কয়েকজন নৌশ্রমিক অভিযোগ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘চাঁদাবাজদের যন্ত্রণায় আমরা অতিষ্ঠ। এলাকার যুবক ছেলেদের দিয়ে চাঁদাবাজি করানো হচ্ছে। চাঁদা না দিলে লাঞ্ছিত করা হচ্ছে।’

বাল্কহেড চালক মো. শানু মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে আসছি। এখানে আসার পর আমার কাছে সুরমা ইউনিয়নের নামে ট্যাক্স দাবি করা হয়। আমি ট্যাক্স দেইনি বলে চাঁদাবাজরা আমাকে বেধড়ক মারধর করেছে। পরে আমার সঙ্গে থাকা শ্রমিকরা চাঁদাবাজদের কথামতো চাঁদা দিয়ে আমাকে ওদের হাত থেকে রক্ষা করে।’

বাল্কহেড চালক রুমান মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত ১০ বছর ধরে ঢাকা থেকে বাল্কহেড নিয়ে এসে আমি সুরমা ইউনিয়নের বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ব্যবসা করছি। আমির হোসেন রেজা চেয়ারম্যান হয়ে নতুন করে ইউনিয়ন ট্যাক্স নেওয়া শুরু করেছেন। যারা ট্যাক্স দিতে চাননা তাদের ওপর চাঁদাবাজরা অমানবিক নির্যাতন চালান। এক হাজার টাকা করে নেওয়া হলেও রসিদে ৫০০ টাকা লেখা হচ্ছে।’

ইউপি চেয়ারম্যান সাংবাদিককে বললেন, ‘আইও, তুমারেও চাঁদাও দিমুনে’

নৌকার চালক পাবেল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে এখন দ্রব্যের দাম আকাশছোঁয়া। তার মধ্যে চাঁদাবাজদেরও টাকা দিতে হচ্ছে। পুলিশের কাছে অনুরোধ এসব চাঁদাবাজি যেন দ্রুত বন্ধ করা হয়।’

চাঁদা আদায় করছিলেন জাহিদুর নামের একজন যুবক। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কথায় আমরা চাঁদা তুলছি। চাঁদার ভাগ ওপর মহলসহ ১০ জন ব্যক্তি পায়।’

ইউপি চেয়ারম্যান সাংবাদিককে বললেন, ‘আইও, তুমারেও চাঁদাও দিমুনে’

‘তোমারেও চাঁদা দিমুনে’

কোনো ধরনের ইজারা ছাড়া কেন সুরমা ইউনিয়নের তিনটি পয়েন্টে চাঁদা তোলা হচ্ছে, এ বিষয়ে জানতে চান জাগোনিউজ২৪.কম-এর সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি লিপসন আহমেদ। প্রথমে চাঁদা তোলার কথা অস্বীকার করেন সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমির হোসেন রেজা। পরে নিজেই ফোন দিয়ে বলেন, ‘তুমি কে বা? আমার উকিলপাড়া অফিসে আসো, তোমাকে দেখি। আর শোনো, আমার ইউনিয়ন নিয়ে কিছু লিখলে আমার সাথে কথা বলে আমার সাথে বসে লিখতে হবে। আমার ইউনিয়ন নিয়ে কারও সাথে কোনো কথা বলা যাবে না। কথা বললে একমাত্র আমার সাথে কথা বলবে।’

পরে চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করা হয় আপনার সুরমা ইউনিয়নের চাঁদা আদায়কারী জাহিদুর বলছেন, আপনার নেতৃত্বে তারা চাঁদা তুলছেন। জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমার অগোচরে আমার ইউনিয়নের ছেলেরা চাঁদা তুলছে। এটা নিয়ে তোমরা কথা কইতায় কেনে? যারা চাঁদা তোলে তারা আমার লোক।’

ইউপি চেয়ারম্যান সাংবাদিককে বললেন, ‘আইও, তুমারেও চাঁদাও দিমুনে’

তিনি আরও বলেন, ‘চাঁদা তো অনেকেই তোলে। কেউ তোলে কলম দিয়ে, কেউ তোলে মুগুর দিয়ে আবার কেউ তোলে রিসিট দেখিয়ে। আমার উকিলপাড়া অফিসে একবার আইও। তোমারেও চাঁদা দিমুনে।’

এ বিষয়ে সুনামগঞ্জ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইখতিয়ার উদ্দিন চৌধুরীর বক্তব্য নিতে চাইলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সিলেট নৌপথের পুলিশ সুপার (এসপি) শম্পা ইয়াসমিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘নৌপথে চাঁদাবাজি কিছুতেই সহ্য করা হবে না। যারাই নৌপথে চাঁদাবাজি করবেন তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইমরান শাহারিয়ার জাগো নিউজকে বলেন, ‌‘সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যদি মানুষকে হয়রানি করে চাঁদা তোলেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আপনার মাধ্যমে বিষয়টি জানলাম। এটি যাচাই-বাছাই করা হবে। সুরমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান যদি নদী থেকে অবৈধভাবে চাঁদা তুলে থাকেন তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখবো।’

লিপসন আহমেদ/এসআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।