ঝালকাঠির ২০ গ্রামে দিনরাত চলছে মুড়ি ভাজা উৎসব
আর কয়েকদিন পরেই শুরু হবে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে পুণ্যের মাস রমজান। এ মাসে দিনব্যাপী সিয়াম সাধনার পরে ইফতারে অন্যান্য উপাদানের সঙ্গে মুড়ি একটি অন্যতম খাদ্যপণ্য। রমজানকে ঘিরে ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের ২০টি গ্রামে এখন দিনরাত চলছে মুড়ি ভাজার উৎসব।
এ গ্রামগুলো থেকে জেলার চাহিদা পূরণ করে শতাধিক মণ মুড়ি দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এখানে বছরে প্রস্তুত করা হয় প্রায় কোটি টাকার মুড়ি। রমজানের চাহিদা মেটাতে নারীদের পাশাপাশি পুরুষরা সমানতালে মুড়ি প্রস্তুত করতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। তবে এ ব্যবসায় জড়িত মধ্যস্বত্বভোগীদের ভাগ্য ফিরলেও যারা মুড়ি তৈরি করেন নিজস্ব পুঁজি না থাকায় তাদের ভাগ্য বদলায় না।
ঝালকাঠির মুড়ি পল্লী নামে পরিচিত নলছিটি উপজেলার দপদপিয়া ইউনিয়নের তিমিরকাঠি, জুড়কাঠি, ভরতকাঠি, দপদপিয়া এবং রাজাখালি গ্রামের ২৫০টি পরিবার যুগ যুগ ধরে মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এছাড়া আশপাশের আরও অন্তত ১৫টি গ্রামে চলে মুড়ি তৈরির এই কার্যক্রম। সুস্বাদু মুড়ি হিসেবে সারাদেশে সমাদৃত নলছিটির মুড়ি। সব পরিচয় ছাপিয়ে এই গ্রামগুলো এখন মুড়ির গ্রাম নামেই পরিচিতি পেয়েছে।
নাখোচি জাতের ধান প্রক্রিয়াজাত করে এ মুড়ির চাল তৈরি করা হয়। এখানকার মুড়িতে কোনো ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয় না। এজন্য স্বাস্থ্যসম্মত ও খেতে সুস্বাদু। বর্তমানে ১২০ টাকা দরে প্রতি কেজি মুড়ি খুচরা বিক্রি হয়। মুড়ির কারিগরদের নিজস্ব পূঁজি না থাকায় আড়তদারদের কাছ থেকে দাদন নিতে বাধ্য হন।
রমজানের বাড়তি চাহিদা এবং কিছু বেশি আয়ের জন্য রাত ৪টা থেকেই শুরু হয় মুড়ি ভাজা, চলে পরদিন দুপুর পর্যন্ত। তীব্র গরমে কাঠ ফাটা অসহ্য গরম উপেক্ষা করে চাহিদার যোগান দিতে মুড়ি ভাজেন কারিগররা।

কয়েকজন মুড়ি প্রস্তুতকারী ও মুড়ি ব্যবসায়ীর (আড়তদার) সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, মুড়ি ভাজার জ্বালানি কাঠ ও আনুষঙ্গিক কিছু খরচ বাদে প্রতি ৫০ কেজি চালের মুড়ি তৈরি করে মজুরি পান মাত্র ৪০০ টাকা। এই অর্থেই চলে তাদের জীবন-জীবিকা, ছেলেমেয়েদের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচ। এখানকার মুড়ি সুস্বাদু হওয়ায় সারাদেশেই এর সমাদর রয়েছে। ঢাকা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকাররা এখান থকে মুড়ি নেন। বাজারে খুচরা দরে প্রতি কেজি ১২০ টাকা বিক্রি হলেও পাইকারি দর প্রতিকেজি ৯০ টাকা। বছরের পর বছর মুড়ি ভেজেও কেবল পুঁজির অভাবে ভাগ্য ফেরাতে পারেনি এই পরিবারগুলো। মুড়ি ভাজাকে কুটির শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে বিশেষ ঋণের ব্যবস্থা করা হবে, এমনটাই এ শিল্পে জড়িতদের প্রত্যাশা।
শুধু নলছিটিতেই নয়, জেলার বিভিন্ন স্থানে এ মৌসুমে মুড়ি ভাজার কারিগরেরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। প্রত্যেকটি মুড়ি ভাজার ঘরেই এখন উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে।
ভরতকাঠি গ্রামের মুড়ি প্রস্তুতকারী নারী আয়েশা বেগম বলেন, এ কাজে চুলার আগুনের প্রচণ্ড গরম সহ্য করতে হয়। তাই যাদের বয়স বেড়েছে, তাদের এ কাজে কষ্ট হয়। তবে এটি নারীদের জন্য আলাদা কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছে।
জানতে চাইলে জেলা সদরের মুড়ির পাইকারি ব্যবসায়ী মানিক লাল কৌড়া বলেন, এ অঞ্চলের হাতে ভাজা মোটা মুড়ির জনপ্রিয়তা ও কদর অনেক বেশি। কিন্তু মেশিনে ভাজা চিকন মুড়ির কারণে হাতে ভাজা মুড়ির বেচাকেনায় কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মেশিনের মুড়ির কারণে হাতে ভাজা মুড়ি কম দামে বিক্রি করতে হয়। এ কারণে শ্রমিকেরা কম টাকা পাচ্ছেন।
দপদপিয়া ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন বাবুল মৃধা বলেন, এখানকার বেশকিছু পরিবার মুড়ি শিল্পের সঙ্গে জড়িত। শুধু এই সিজনেই (সময়ে) তাদের মুড়ি ভাজার কাজ থাকলেও বাকি সময় তাদের বেকার থাকতে হয়। আমন ধানের ভাজা মুড়ির জন্য নলছিটি বিখ্যাত। দেশের চাহিদা পূরণ করে দেশের বাইরেও এ অঞ্চলের মুড়ি রপ্তানি হয়।
বিসিক ঝালকাঠির উপ-ব্যবস্থাপক মো. শাফাউল করীম বলেন, এ এলাকা মুড়ির জন্য বিখ্যাত। তাই এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা সমিতি গঠন করে ঋণ নিতে চাইলে, তা দেওয়া হবে।
এমআরআর/এএসএম