আখের অভাবে বেড়েছে নাটোর চিনিকলের লোকসান
আখের স্বল্পতা, আর্থিক সংকট, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে নাটোর চিনিকল। গত ১১ বছরে চিনিকলটি প্রায় ২৮০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। অন্যদিকে দাম না পেয়ে কৃষকরা আখ চাষ কমিয়ে দিয়ে অন্য ফসলের চাষাবাদ শুরু করেছেন। এছাড়া বেতন-ভাতা না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন মিলের শ্রমিক-কর্মচারীরা।
চিনিকল সূত্রে জানা যায়, নাটোর চিনিকলটি ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠার পর প্রথম চার-পাঁচ মৌসুম লাভজনক হলেও এরপর থেকে লোকসান করতে থাকে। আখ চাষ সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় আখের বীজ, সার ও কীটনাশক কৃষকের চাহিদামতো সরবরাহ করতে পারেনি চিনিকল কর্তৃপক্ষ। ফলে আখ উৎপাদন কমে যায়। প্রয়োজনীয় আখের অভাবে চিনি উৎপাদন কমতে থাকে। সর্বশেষ গত অর্থবছর সর্বনিম্ন আখ মাড়াই করে চিনিকলটি। ফলে লোকসানের মাত্রাও বেড়ে যায়।
এছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে আখের মূল্য সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি চিনিকলটি। বাধ্য হয়ে কৃষকরা বকেয়া বিল পরিশোধের দাবিতে দফায় দফায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেন।
জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে নাটোর চিনিকলের আওতাধীন আখের জমি ছিল ১৪ হাজার ৫৮৪ একর। ২০২০-২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়িয়েছে চার হাজার ৫৩৫ একরে। গত মাড়াই মৌসুমে নাটোর চিনিকলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মাত্র ৪২ কর্মদিবস আখ মাড়াই করে চিনিকলটি উৎপাদন করে ৩ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন চিনি। এত অল্প পরিমাণ চিনি উৎপাদনের ফলে চিনিকলটি লোকসান করে প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছরে নাটোর চিনিকলের আওতাধীন আখের জমি ছিল ১৪ হাজার ৫৮৪ একর। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত আখের অভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই চিনিকলটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং কারখানাটি লোকসান করে ৩০ কোটি টাকা।
নাটোর চিনিকলের আখ চাষি নেতা মসলেম উদ্দিন বলেন, কয়েক বছর ধরে চাষিরা মিলে আখ দিলেও সময়মতো টাকা পাননি। এছাড়া আগে সার, বীজ ও কীটনাশক দেওয়া হলেও গত বছর তা করা হয়নি। ফলে চাষিরা আখ চাষে নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েছেন। কমছে আখের আবাদ।
আরেক শ্রমিক নেতা সাইফুল ইসলাম বলেন, চাষিদের সময়মতো আখের মূল্য পরিশোধ করতে না পারাসহ সার, বীজ ও কীটনাশক না দেওয়ায় আখ চাষ কমে গেছে। তিনি বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে মিলটি লাভজনক করা যাচ্ছে না। এছাড়া উন্নত জাতের আখের চাষ সম্প্রসারণ এবং সময়মতো আখের মূল্য পরিশোধ ও কারখানা এবং পরিবহনে ব্যবহৃত ট্রাক্টরগুলো মেরামত ও আধুনিকায়ন করা হলে মিলটি লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে পারবে।
এ অবস্থায় চাষিদের প্রণোদনার আওতায় আনার পাশাপাশি উন্নতমানের আখ বীজ সরবরাহের মাধ্যমে সংকট নিরসনের দাবি জানান তিনি।
আখ চাষি আব্দুল করিম, মিঠু ও সাইদুল ইসলাম জানান, চিনিকলে আখ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় পুঁজি ও সঠিক সময়ে আখের দাম না পাওয়ায় আখ চাষ কমিয়ে দিয়েছেন কৃষকরা। এছাড়া চিনিকলের বাইরে আখ বিক্রি করলে নগদ টাকা ও দাম বেশি পাওয়া যায়। ফলে মিলে আখ সরবরাহের উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন কৃষক। এছাড়া অনেক কৃষক আখ চাষ ছেড়ে অন্যান্য আবাদে ঝুঁকে পড়েছেন।
নাটোর চিনিকলে কর্মরত কয়েকজন শ্রমিক জানান, গত ২৫ মার্চ তারা ডিসেম্বর মাসের বেতন পেয়েছেন। জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের বেতন এখনো পাননি। কবে বকেয়া বেতন পাবেন তা জানেন না। ফলে পরিবার নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
চিনিকলের অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ২০১০-১১ অর্থবছর থেকে ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত চিনিকলটি লোকসান করেছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। সবমিলিয়ে গত ১১ বছরে চিনিকলটি প্রায় ২৮০ কোটি টাকা লোকসান করেছে।
নাটোর চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু বকর বলেন, গত মৌসুমে নাটোর চিনিকলে আখ স্বল্পতার কারণে চিনি উৎপাদন কমেছে। আখের অভাবে মাড়াই মৌসুম শুরুর ৪২ দিন পরে তিন হাজার ৭০০ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন করে কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন খরচ বেশি পড়েছে। এছাড়া কিছু চিনিকল বন্ধ করে দেওয়ায় ওইসব চিনিকল থেকে কিছু শ্রমিক-কর্মচারী শূন্যপদের বিপরীতে নাটোর চিনিকলে সমন্বয় করা হয়েছে। তাদের বেতন-ভাতা অনেক বেশি। ফলে চিনি উৎপাদন খরচ পড়েছে বেশি।
তিনি আরও বলেন, গত মৌসুমে ২২ কোটি টাকার চিনি উৎপাদন করলেও ব্যয় হয়েছে ১২৫ কোটি টাকা। সেই হিসেবে কেজিপ্রতি দাম পড়েছে প্রায় ৪০০ টাকার মতো। চিনিকল জোন এলাকায় আখের চাষ সম্প্রসারণ করে চিনিকলটি লোকসান কমিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
রেজাউল করিম রেজা/এমআরআর/জেআইএম