পদ্মাকে নাল দেখিয়ে ৪৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা!

এ কে এম নাসিরুল হক এ কে এম নাসিরুল হক , মাদারিপুর
প্রকাশিত: ১০:২০ এএম, ০৩ এপ্রিল ২০২২

পদ্মা নদীকে নাল দেখিয়ে দালাল চক্রের ৪৬০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার বড় ধরনের একটি অপচেষ্টা ভণ্ডল হয়েছে। স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ছবি অনুসারে একটি মৌজায় মাত্র ৩১ একর জমি নাল থাকলেও জালিয়াতির মাধ্যমে আরো ১৯৫ একর নদীকে নাল দেখিয়ে বিল উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়।

তবে এটি আটকানো গেছে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুনসহ প্রশাসনের উদ্যোগ ও চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরীর কঠোর অবস্থানের কারণে। এমনটাই দাবি করেছে জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্প থেকে নদীশাসন প্রকল্পের সুবিধার্থে ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি পদ্মা নদী তীরের শিবচরের ৬টি মৌজায় ২২৬.২৭ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। এরমধ্যে ৫নং মাদবরচর মৌজায় ২৬ দশমিক ১৪ একর নাল, ৯৭নং দক্ষিণ চরজানাজাত মৌজায় ৪২ দশমিক ৪৮ একর নাল, ৯৫নং বড় কেশবপুর মৌজায় ২০ দশমিক ৫০ একর নাল, ৯৬নং কাঁঠালবাড়ি মৌজায় ১০৮ দশমিক ৭৪ একর নাল, ৯৪নং বাঘিয়া মৌজায় ২৫ দশমিক ৫০ একর নাল ও ১০০নং ভাষালদি মৌজায় ২ দশমিক ৯১ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। প্রস্তাবিত জমি নদী সংলগ্ন হওয়ায় ও অনেক জমির রেকর্ডীয় শ্রেণি নদী হওয়ায় প্রস্তাবিত জমি এডিলাইনের মাধ্যমে নদীর জমি চিহ্নিত করে খাস খতিয়ানে আনার জন্য তৎকালীন সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) নির্দেশনা প্রদান করা হয়।

পদ্মাকে নাল দেখিয়ে ৪৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা!

এরমধ্যেই প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় থেকে প্রস্তাবিত ২২৬.২৭ একর জমির সম্ভাব্য প্রাক্কলিত মূল্য পাঠানোর জন্য জেলা প্রশাসনকে অনুরোধ জানানো হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে জেলা প্রশাসন থেকে প্রস্তাবিত জমির কিছু নদীতে বিলীন, কিছু জমি নাল শ্রেণি ও ড্রেজিং কার্যক্রম শুরু হয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে প্রকৃতপক্ষে কতটুকু জমি অধিগ্রহণ প্রয়োজন তা উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালককে পুনরায় পত্র দেওয়া হয়। তবে সম্পূর্ণ জমি নদীশাসনের এলাইনমেন্টের মধ্যে থাকায় ২২৬.২৭ একর জমি সেতু কর্তৃপক্ষের নামে মালিকানায় আনার জন্য জেলা প্রশাসনকে পুনরায় অনুরোধ করে পদ্মা সেতু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।

২০২০ সালের মার্চে সংশ্লিষ্ট যাচাই কমিটি জেলা প্রশাসনের কাছে অধিগ্রহণের সম্ভাব্যতা যাচাই প্রতিবেদন দাখিল করে। উক্ত প্রতিবেদনে খাস জমি ও নদী শ্রেণির বিষয়টি উঠে আসায় যৌথ তদন্তকালে নাল ও নদী শ্রেণি চিহ্নিত করে বাস্তব শ্রেণিভিত্তিক ফিল্ড বই প্রস্তুত করার জন্য সুপারিশ করা হয়। ইতোপূর্বে কিছু জমি অধিগ্রহণ হওয়ায় ০.১৪ একর জমি বাদ দিয়ে ২২৬ দশমিক ১৩ একর জমি অধিগ্রহণের ও ৪ (১) ধারায় নোটিশ প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫৫৩ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা চূড়ান্ত করা হয়।

উক্ত টাকা প্রত্যাশী সংস্থা কর্তৃক জেলা প্রশাসকের অনুকূলে জমা করা হলে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অন্যান্য এলএ কেসে ৬ কোটি ৪৫ লাখ ২২ হাজার ৭৭৩ টাকা সমন্বয় করে ৫৪৬ কোটি ৬৯ লাখ ৩৭ হাজার ২২৭ টাকা অবশিষ্ট থাকে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের জন্য পত্র স্বাক্ষরিতসহ যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হওয়ার পরপরই বর্তমান জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সরকারের ফার্স্ট ট্র্যাক প্রকল্প হওয়ায় জেলা প্রশাসক সরেজমিন প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তিরা জেলা প্রশাসকের কাছে দাবি করেন সমগ্র প্রকল্প এলাকা বাস্তবে নদী শ্রেণির হলেও ড্রেজিংয়ের ফলে নাল জমি নদী শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে। তারা দালালদের সহায়তায় প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নে তোড়জোর ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়।

পদ্মাকে নাল দেখিয়ে ৪৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা!

বিষয়টি নিয়ে জমি সংক্রান্ত জটিলতা ও সন্দেহ দেখা দিলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (রাজস্ব) প্রধান করে ৯ সদস্য বিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। জেলা প্রশাসককে এমন পরিস্থিতিতে স্থানীয় সংসদ সদস্য চিফ হুইপ নূর-ই-আলম চৌধুরী পূর্ণ সমর্থন দেন। সংসদ সদস্য দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানান কর্মকর্তাদের।

তদন্ত কমিটি ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রস্তাবিত জমির নাল ও নদী শ্রেণি স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণপূর্বক চিহ্নিত করে মৌজাভিত্তিক নকশা ও স্ক্র্যাচম্যাপ প্রত্যাশী সংস্থার কাছে চায়। কয়েক মাস পর প্রত্যাশী সংস্থা সেন্টার ফর ইনভাইরনমেন্টাল অ্যান্ড জিও গ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসের (সিইজিআইএস) সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করে জিওরেফারেনসিংয়ের মাধ্যমে ডিজিটাল জিআইএস ম্যাপ প্রস্তুত করে সেই মোতাবেক স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে অধিগ্রহণের এলাইনমেন্ট যুক্ত দাগসমূহের শ্রেণি সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।

সিইজিআইএসের প্রতিবেদনে অধিগ্রহণের প্রস্তাবকৃত ৬টি মৌজার মধ্যে শুধুমাত্র কাঁঠালবাড়ি মৌজায় ৩০.৮০ একর নাল ও ০.২৫ একর জমি ডোবাসহ মোট ৩১.০৫ একর নাল জমির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। অপর ৫টি মৌজার ১৯৫.০৮ একর নদী শ্রেণি হিসেবে পাওয়া যায়। তদন্ত কমিটি কর্তৃক পুনঃযৌথ তদন্ত ও ফিল্ডবুক সম্পন্ন করে চূড়ান্ত দাগসূচি প্রস্তুত করা হয়। পরবর্তীতে বিধি মোতাবেক সংশ্লিষ্ট জমির মালিককে ৭ ধারার নোটিশ দেওয়া হয়।

কোনো আপত্তি না থাকায় ক্ষতিপূরণ বাবদ ৫৫৩ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৯৩ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৩ টাকা চূড়ান্ত করা হয়। এতে করে জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ সরকারের ৪৬০ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ৩০৭ টাকা সাশ্রয় হয়।

পদ্মাকে নাল দেখিয়ে ৪৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা!

স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলেন, বিভিন্ন প্রকল্পকে ঘিরে দালাল চক্র তৈরি হয়েছে। দালাল চক্রের যোগসাজশেই নদীশাসন বাঁধ নিয়ে এত বড় দুর্নীতির ফাঁদ পাতা হয়েছিল। প্রকল্পটির জন্য তালিকাভুক্তদের কাছ থেকে টাকা তুলে কয়েক কোটি টাকার ফান্ডও ম্যানেজ করা হয়েছে প্রশাসনকে ম্যানেজ করতে। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুনসহ জেলা প্রশাসনের কঠোর অবস্থানের কারণে।

এই নদীশাসন প্রকল্পের ৭ ও ৮ ধারা নোটিশপ্রাপ্ত ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষক তাঁরা মিয়া বলেন, কাঁঠালবাড়ি মৌজায় ৩০.৮০ একর জমির মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে আমরা ৭ ও ৮ ধারার নোটিশ পেয়েছি।

৯৫নং বড় কেশবপুর মৌজার অন্তর্ভুক্ত কুতুবপুর ইউপি চেয়ারম্যান আতিকুর রহমান মাদবর বলেন, এ প্রকল্পে অধিগ্রহণকৃত বড় কেশবপুর মৌজার জমিগুলো ২০১৭ সালের আগে থেকেই নদী ছিল। দালালচক্র জমিগুলোকে নাল দেখিয়ে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সরকারের কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হয়েছে। আমরা চাই যে জমিই অধিগ্রহণ করা হোক সেখানে যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে সবাই কাজ করে। তাহলে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পাবে।

৫নং মাদবরচর মৌজা ও দক্ষিণ চরজানাজাত মৌজার অন্তর্ভুক্ত মাদবরচর ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুল হক মুন্সি বলেন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতারা সমন্বয়ে কাজ করলে দুর্নীতি যে রোধ করা যায় তার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ পদ্মা সেতুর নদীশাসন প্রকল্পে সরকারের এত বড় অংকের টাকা সাশ্রয়।

পদ্মাকে নাল দেখিয়ে ৪৬০ কোটি টাকা লোপাটের চেষ্টা!

তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক মাদারীপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ঝোটন চন্দ বলেন, তদন্ত কমিটিতে রেলওয়ে, গণপূর্ত বিভাগ, বনবিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সকল বিভাগ সমন্বয়ে তদন্ত করে। স্যাটেলাইট ইমেজ ছাড়াও সরেজমিন পরিদর্শনসহ বিভিন্ন উপায়ে মূল ড্রেজিংকৃত জায়গা শনাক্ত করা হয়। এতে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হয়েছে।

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন বলেন, আমার কাছেও দালালরা একই দাবি করেন যে নাল জমি ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদী করা হয়েছে। কিন্তু সরেজমিনে সবই নদী দেখতে পাই। তাই আমি পদ্মা সেতু কর্তৃপক্ষের কাছে অধিগ্রহণকৃত জমি প্রথম প্রস্তাবের সময়ের স্যাটেলাইট ছবি চাই। দাগভিত্তিক জমির শ্রেণির বিবরণ চাই। পদ্মাসেতু কর্তৃপক্ষ সিইজিআইএসের মাধ্যমে এটি জরিপ করিয়ে স্যাটেলাইট ইমেজসহ আমাদের কাছে রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। সেখানে দেখা যায় মাত্র ৩১.০৫ একর জমি নাল ও ডোবা। বাকি জমি নদী শ্রেণির। তাই নদী শ্রেণির জমি অধিগ্রহণের কোনো সুযোগ নেই। তাই প্রকল্পের মূল্য ৫৫৩ কোটি ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকার পরিবর্তে ৯৩ কোটি ১০ লাখ ২৭ হাজার ৬৯৩ টাকা চূড়ান্ত করা হয়। এতে করে জমির ক্ষতিপূরন বাবদ সরকারের ৪৬০ কোটি ৪ লাখ ৩২ হাজার ৩০৭ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়।

তিনি বলেন, চিফ হুইপ স্যারের সহযোগিতা চাইলে তিনি আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন এবং দুর্নীতি রোধে কঠোর অবস্থান নেন। এজন্য আমাদের এত বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়া সহজ হয়েছে।

জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ নূর-ই আলম চৌধুরী বলেন, জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার সকল বিষয়গুলোতো উপজেলা প্রশাসন খুব বেশি অবগত না। জেলা প্রশাসক যখন আমাকে অনিয়মের বিষয়টি জানান তখন আমি তাকে বিষয়টি ভালোভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করতে বললাম। তারা প্রায় সাড়ে ৪শ কোটি টাকার একটি অনিয়ম পেয়েছে। বিপুল পরিমাণ সরকারের এ অর্থ সাশ্রয় হওয়ায় জেলা প্রশাসকসহ প্রশাসনকে ধন্যবাদ। দুর্নীতি রোধে উপজেলা আওয়ামী লীগসহ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি যারা আছে সকলেই প্রশাসনকে সহযোগিতা করবো।

এফএ/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।