‘ঘরে পোয়াতি বউ, ওর জায়গায় আমারে নিলা না কেন’

‘ওরে আল্লাহ রে...আমি কি করবো। তুমি আমার কী পরীক্ষা করতিছাও। তুমি আমার সন্তানরে ফিরায়ে দাও। সে খুব আদরের। আমি কারে নিয়ে বাঁচবো। ওর ঘরে যে পোয়াতি বউ রয়েছে। প্রথম বাপ হবে আমার ইব্রাহিম। সন্তানের মুখ দেখতে পেল না আল্লাহ রে...। আমি কি করবো। ওর জায়গায় তুমি আমারে নিতে পারলে না কেন!’
এভাবেই বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে নিহত ইব্রাহীম হোসেনের মা দুলাপি বেগম। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন বাবা অবসরপ্রাপ্ত মাদরাসা শিক্ষক আবুল কাশেম।
ইব্রাহীমের বাড়ি যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর ইউনিয়নের নরসিংহপুর গ্রামে। সোমবার ভোরে তার মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্সটি গ্রামে পৌঁছালে কান্নার রোল ওঠে।
ভোরের নীরবতা ভেঙে স্বজনদের আহাজারি ছড়িয়ে পড়ে বাড়ি থেকে পাড়ায়, পাড়া থেকে গ্রামে। বিদায়বেলায় ছুঁয়ে দেখতে পারেননি স্বজনরা। কেন না সুঠামদেহী ইব্রাহিমের মরদেহ দগ্ধ। তাই দাফনের আগ পর্যন্ত ফ্রিজিং গাড়িতেই রাখা হয় মরদেহটি। গাড়ির সাদা গ্লাসের ওপরে হাত বুলিয়েই শেষবিদায় জানানো হয় তাকে।
সকাল ১০টায় ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। জানাজায় আশপাশের গ্রামের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।
আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ইব্রাহীমের মৃত্যুর খবরে গত দুই দিন ধরে প্রতিবেশী ও আশেপাশের কয়েক গ্রামের লোকজন তাদের বাড়িতে ভিড় করেন। জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে স্ত্রী মুন্নি খাতুন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। ভাই-বোনসহ অন্য স্বজনদের ক্ষণে ক্ষণে গগণবিদারী আহাজারিতে চারপাশ ভারি হয়ে উঠেছে। বাড়ির ভেতরের বারান্দায় প্রতিবেশী নারীরা নিহত ইব্রাহীমের নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী মুন্নী খাতুনকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন।
মুন্নী খাতুন বলেন, ‘আমার এ জীবন রেখে কী লাভ। আমার পাখি চলে গেছে। ও আল্লাহ আমারেও নিয়ে যাও। আমার পাখিরে রেখে কীভাবে বাঁচবো। আমাদের সন্তানরে নিয়ে ওর কত স্বপ্ন ছিল। এখন কি হবে?’
পাশেই বসা মুন্নীর বড়বোন রেহেনা খাতুন বলেন, ‘মুন্নী নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা। ২৮ জুলাই সন্তান ভূমিষ্ঠের সম্ভাব্য দিন। শনিবার রাত ৯টায় মুন্নীসহ তার মায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয় ইব্রাহিমের। কোরবানির ঈদে বাড়ি এসে সন্তানের মুখ দেখতে চেয়েছিল। একই সঙ্গে সন্তান ও মুন্নীরে চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ছেলে হলে মাদরাসায় পড়াতে চেয়েছিল, হাফেজ বানাতে চেয়েছিল। আমার বোন-জামাইয়ের সেই আশা আর পূরণ হলো না।’
ইব্রাহিমের খালাতো ভাই নাজমুল হোসেন বলেন, শনিবার (৪ জুন) রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ইব্রাহিম আগুনে দগ্ধ হয়। তার আগে সে বাড়িতে মা, বাবা ও স্ত্রীসহ অন্য স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে। বিস্ফোরণে তার মাথার পেছনে ও পেটে আঘাত ও আগুন লাগে। মুখ, টি-শার্ট ও মোবাইল ফোন দেখে তাকে শনাক্ত করি। উদ্ধারের সময় তার ফোনটি সচল ছিল।’
আরেক খালাতো ভাই শিমুল হোসেন বলেন, ‘শনিবার রাতে অনেকের মতো ইব্রাহিমও অগ্নিকাণ্ডের ভিডিও ফেসবুকে লাইভ করছিল। কিছু সময় পর হঠাৎ ডিপোর কনটেইনারগুলোতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এরপর ঘটনাস্থলে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে তাকে পাওয়া যায়নি। পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মরদেহ পাওয়া যায়। দেড় বছর আগে নিজ গ্রামেই বিয়ে করে সে। তার এমন মৃত্যুতে তার অনাগত এই সন্তানের কী হবে সেটাই ভাবছি আমরা। আল্লাহ যেন আর কারও এমন মৃত্যু না দেয়।’
মিলন রহমান/এসজে/এমএস