গাইবান্ধা-৫ উপ-নির্বাচন
‘সুষ্ঠু ভোট হয়েছে’ লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কর্মকর্তারা!
গাইবান্ধা-৫ (ফুলছড়ি-সাঘাটা) আসনে উপ-নির্বাচনের দিন বহিরাগত যুবকদের কাছে ‘সুষ্ঠু ভোট হয়েছে’ লিখে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা। সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের চাপেই তারা এমন লিখিত দেন। বাস্তবে ভোটের পরিবেশ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। কেন্দ্র দখল ও প্রভাব বিস্তার ছাড়াও অন্যের ভোট জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকে দিতে বাধ্য করা হয় অনেক ভোটারকে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের করা তদন্ত কমিটির কাছে এসব তথ্য স্বীকার করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
বুধবার (১৯ অক্টোবর) সাঘাটা উপজেলা সম্মেলন কক্ষে দ্বিতীয় দিনের তদন্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট ৫২২ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ইসির তদন্ত কমিটি। এতে নির্বাচনের নানা অনিয়ম ও ভোট ডাকাতির চিত্র তুলে ধরেন সংশ্লিষ্টরা।
তদন্তের দ্বিতীয় দিনে সাঘাটা ও ফুলছড়ি উপজেলার ৪০ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ২৭৮ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ২০০ জন পোলিং এজেন্ট (প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষে), সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা, সাঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ৫২২ জনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ সময় সিসি টিভির ফুটেজ দেখিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চায় ইসির তদন্ত কমিটি।
শুনানিতে উপস্থিত ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তা সূত্রে জানা গেছে, তাদের সিসিটিভি ফুটেজ দেখিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে। অনেক কেন্দ্রের কর্মকর্তা, পোলিং এজেন্টরা বুথে বহিরাগতদের উপস্থিতি ও ভোট প্রভাবিত করার কথা কমিটির সামনে বলেছেন। সেদিন নির্বাচনী পরিবেশ ও কেন্দ্রে প্রভাব বিস্তারের বিষয়ে তারা বিস্তারিত বলেন। তবে, অনেকে কৌশলে প্রসঙ্গ এড়িয়ে যান।
অন্যদিকে, নির্বাচন কমিশন গঠিত তদন্ত কমিটির বিরুদ্ধে ভয়ভীতি দেখিয়ে লিখিত জবানবন্দি দেওয়ার অভিযোগ করেছেন কেউ কেউ। কিন্তু তারা শাস্তির ভয়ে প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হননি।
মাঠ প্রশাসন, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাসহ ৬৮৫ জনকে তিনদিনের শুনানির জন্য তলব করে ইসির তদন্ত কমিটি। এরআগে প্রথম দিন ফুলছড়ি উপজেলার ১১ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৬৬ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা, ৫৫ জন পোলিং এজেন্ট (প্রত্যেক প্রার্থীর পক্ষ থেকে), গাইবান্ধা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ ১৩৬ জনের শুনানি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভোটের দিন সকাল থেকে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলছিল। দুপুর ১২টা নাগাদ কয়েকজন সাদা গেঞ্জি পরিহিত যুবক কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। তারা ভোটদানের গোপন কক্ষে গিয়ে জোর করে নির্দিষ্ট প্রতীকের বাটনে চাপ দেন। বিষয়টি ইসি পর্যবেক্ষণ করার পর ভোটগ্রহণ স্থগিত করা হয়। এরপর আমাকে ভোটের সব সরঞ্জাম নিয়ে নির্বাচন অফিসে জমা দিতে বলা হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেদিন পুরো ভোটগ্রহণ স্থগিত হওয়ার পর আমার সঙ্গে সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা দেখা করেন। জোর করে ভোটের পরিবেশ ভালো ছিল—এমন স্টেটমেন্ট লিখে নেন। এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বললে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেন তারা।’
সন্ন্যাসদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মাজেদুল ইসলাম বলেন, ‘সেদিন সকাল থেকে ভোটগ্রহণ চলছিল। এরপর হঠাৎ ইসির ফোন পাই। তখন তিনি পাশের একটি কক্ষে যেতে বলেন। সেখানে গিয়ে সাদা গেঞ্জি পরিহিত এক যুবককে আটক করতে বলেন। পরবর্তী সময়ে আমি তাকে আটক করে আমার কক্ষে রাখি। এরপর নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়, আমার কেন্দ্রের ভোটগ্রহণ বন্ধ করা হয়েছে। আমাকে ভোটের সব সরঞ্জাম নিয়ে নির্বাচন অফিসে জমা দিতে বলেন। পরে ইসির নির্দেশে ওই যুবকের বিরুদ্ধে মামলা করেছি।’
তবে মজিদের ভিটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘সেদিন আমার কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ চলছিল। কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। ভোটে প্রভাব বিস্তার করার বিষয়ে আমি কিছু জানি না। আমাকে নির্বাচন কমিশন থেকে ভোটগ্রহণ বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে ভোটের সরঞ্জাম নিয়ে আমি চলে যাই।’
শুনানি শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তদন্ত কমিটির প্রধান অশোক কুমার দেবনাথ। তিনি বলেন, নির্বাচন অনিয়ম খতিয়ে দেখতে আমরা ৬৮৫ জনকে শুনানির জন্য ডেকেছি। দ্বিতীয় দিনে ৫২২ জনকে জেরা করা হয়েছে। তাদের কাছে নির্বাচনে অনিয়ম সম্পর্কে মৌখিক ও লিখিত বক্তব্য নিয়েছি।
তবে, কী কী অনিয়মের বিষয়ে জানতে পেরেছেন, সে বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি তদন্ত কমিটি।
এসআর/এএসএম