সিডরের ১৫ বছরেও শেষ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ
উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডরে প্রাণ হারিয়েছেন ৯০৮ জন। রাতেই লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূল। ভোরের আলো ফুটতে দৃশ্যমান হতে থাকে তাণ্ডবের চিত্র। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পুরো জেলা। স্বজনহারা ও আহতদের কান্নায় ভারি হয়ে ওঠে বাগেরহাটের আকাশ-বাতাস।
সরকারি হিসাবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত ও আহত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬০০ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা এক লাখ ছয় হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাঁচ কিলোমিটার পাকা সড়ক ও প্রায় ৫০ কিলোমিটার কাঁচা সড়ক। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদি পশু। বিনষ্ট হয় ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও আট হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ির ঘের।
সিডরের সেই ভয়াবহতা আজও তাড়িয়ে বেড়ায় উপকূলবাসীকে। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে ওঠেন অনেকেই। ২০০৭ সালে কাজের জন্য দুই বোনের সঙ্গে চট্টগ্রামে ছিলেন শরণখোলার শফিকুল ইসলাম পঞ্চায়েত। বাড়িতে বাবা-মা, ছোট ভাই, দুই ভাগ্নি আর ভাগ্নে ছিল। ঝড়ের পরের দিন অনেক কষ্টে শরণখোলায় ফিরে আসেন তারা। বাড়িতে এসে শুধু ছোট ভাই মো. সোহাগকে জীবিত পেয়েছিলেন। বাকি সবাই ভেসে গেছে জলোচ্ছ্বাসে। স্বজন হারানোর কথা পড়লে আজও থমকে যান তারা।

এই পরিবারের মধ্যে বেঁচে যাওয়া মো. সোহাগ বলেন, ২০০৭ সালে আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তাম। বৃষ্টিতে ভিজে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি আসি। মা একটু রাগও করে। সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় বাতাস। রাত আনুমানিক ৯টার দিকে মানুষের ডাক-চিৎকারে আমরাও বাড়ি থেকে বের হই। প্রথমে পাশের বাড়ি আশ্রয় নেই। ঘরের মধ্যে পানি আসতে শুরু করলে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশে বের হই। অন্ধকার আর প্রতি মুহূর্তে পানি বাড়ছে। হঠাৎ পানির তোড়ে পরিবারের থেকে দলছুট হয়ে যাই। স্রোত আমাকে বড় একটি গাছের ওপর ছুড়ে মারে। আর এই গাছ ধরেই বেঁচে যাই আমি। সকালে পরিবারের কাউকে খুঁজে পাইনি। চারদিন পর মায়ের মরদেহ আর ১০ দিন পরে বাবার মরদেহ খুঁজে পাই।
বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী এলাকায় দেখা যায়, এখনও সেখানে কয়েকটি ঝুপরি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘরে থাকেন জয়নব বিবি (৮০)। সিডরে হারিয়েছেন থাকার জায়গা ঘরটুকু। সন্তানরা বাইরে থাকে। কোনো রকম মানুষের কাছে চেয়ে দিন কাটে তার। বাঁধের পাশে ঘরটুকু পেয়েছিলেন তাও যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারে। হালকা বাতাস হলেও দুঃশ্চিন্তায় রাত জেগে থাকতে হয় তাকে। এই নড়বড়ে ঘরই তার একমাত্র সম্বল।
গাবতলা গ্রামের বাহাদুর খান জানান, সিডর তার এক বোন, চাচা ও চাচিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কয়েকদিন পর ধানক্ষেত থেকে তাদের মরদেহ উদ্ধার করে দাফন করেন। স্বজন হারানো বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে উপকূলবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। সিডরের ১৫ বছরেও শরণখোলাবাসীর প্রাণের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ শেষ হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৫ সালে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। বেড়িবাঁধের প্রায় ৬০ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হলেও অরক্ষিত রয়ে গেছে সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা আশার আলো মসজিদ থেকে বগী, তেরাবাকা-শরণখোলা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার বাঁধ।
২০১৬ সালে ২৬ জানুয়ারি শুরু হয় কাজ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার পরবর্তী সময়ে আরও তিন দফা সময় বাড়িয়েছেন। সবশেষ বর্ধিত মেয়াদ অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাঁধ হস্তান্তরের কথা রয়েছে।
নদীশাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করে ভাঙনের প্রতিকার মিলবে বলে দাবি স্থানীয়দের। এসব বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়িবাঁধে পর্যাপ্ত স্লুইচগেট নির্মাণ না করে অপরিকল্পিতভাবে ছোট করে অল্প সংখ্যক স্লুইচগেট নির্মাণের কারণে বৃষ্টি বা জোয়ারের পানি নিষ্কাশন হয় না ঠিকমতো। ফলে দিনের পর দিন পানিবন্দি থাকতে হয় স্থানীয়দের।
স্থানীয়রা জানান, একটু ভারি বৃষ্টি হলেই কয়েকদিন পানিবন্দি হয়ে পড়তে হয় তাদের। পানি নামার ব্যবস্থা না থাকায় গত ২৭ জুলাই বৃষ্টির পানিতে সাতদিন পানিবন্দি ছিল উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে নিমজ্জিত ছিল আমনের বীজতলা। একসপ্তাহ পরও পানি না নামায়, বাঁধ কেটে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।

স্থানীয় সিদ্দিক ফকির নামের এক ব্যক্তি বলেন, সিডরের পর থেকে আমাদের একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ। কিন্তু ১৫ বছরেও আমাদের এখানে বেড়িবাঁধ নির্মাণ শেষ হয়নি। কোথায় যাবো আমরা, প্রতিবছরই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে আমাদের জানমালের ক্ষতি হয়।
চলতি বছরের ১১ মে দুপুরে শরণখোলা উপজেলার গাবতলা বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধের মাঝে ১৫-২০ ফুট লম্বা ফাটল দেখা যায়। এর আগে, ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
ছফেদ খান বলেন, বেড়িবাঁধের বাইরে আমার এক বিঘা (৬৫ শতক) জমি ছিল। হঠাৎ করে ১০ কাঠা জমি দেবে যায়। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায় জমি। বাকি জমিতেও ফাটল রয়েছে। যেকোনো সময় নদীতে বিলীন হয়ে যেতে পারে। এভাবে বাপ-দাদার অনেক জমি হারিয়েছি আমরা। নির্মাণের বাঁধের মধ্যে মাটি না দিয়ে বালু দেওয়ায় এমন ফাটল ধরেছে বলে দাবি জন প্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর।
সাউথখালী ইউনিয়ন ৭ নম্বর ওয়ার্ডের রিয়াদুল পঞ্চায়েত বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নদীশাসন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। কিন্তু নদীশাসন না করেই বাঁধ নির্মাণ হওয়াতে ঝুঁকি হ্রাস পায়নি। নদীশাসন না করে নির্মিত বাঁধ বড় কোনো দুর্যোগে আবারও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা সংকটে ফেলতে পারে।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিআইপি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় নদীর গতি-প্রকৃতি যেভাবে ছিল, সেভাবে জরিপ করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নদী গতিপথ পরিবর্তনের কারণে ভাঙন দেখা দিতে পারে।
জেএস/জিকেএস