১৭ বছর ধরে গাছের গুঁড়ি দিয়ে ভাস্কর্য বানাচ্ছেন লতিফ

ফরিদপুর পৌর শহরের বাসিন্দা বাহারুল লতিফ (৬২)। একজন প্রতিভাবান ভাস্কর্য শিল্পী। সাধারণ মানুষের চোখে অকেজো ও পরিত্যক্ত গাছের শেকড়, গুঁড়ি বা কাঠ তার হাতের ছোঁয়ায় হয়ে ওঠে এক একটি শিল্পকর্ম। যা মানুষের মন ও দৃষ্টি কাড়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এসএসসি পাসের পরেই থেমে যায় বাহারুলের পড়াশোনা। ছোট বেলা থেকেই আঁকাআঁকিতে প্রবল ঝোঁক ছিল তার। ১৯৮০ সালে শিশু চিত্রকর্মে জাতীয় শিশু একাডেমি পুরস্কার পান। ভাস্কর্য তৈরির কাজও তিনি একাই শিখেছেন।
২০০৫ সাল থেকে কাঠে ভাস্কর্য তৈরি শুরু করেন বাহারুল। ২০১২ সালে তার তৈরি ভাস্কর্য স্থান পেয়েছে জাতীয় যাদুঘরে। এতে আছে ১৯টি দেশীয় প্রজাতির প্রাণী। তার এ শিল্পকর্ম দেশের জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতেও প্রচারিত হয়েছে।
২০১৫ সালে ফরিদপুর শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা পুরস্কার পেয়েছেন বাহারুল। ২০১৬ সালে গাছের শিকড় দিয়ে তৈরি স্পার্ক ৭১ নামের মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাস্কর্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেন তিনি।
বাহারুলের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন সব শিল্পকর্ম। কাঠে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, কবি-সাহিত্যিক, মনীষী, বিখ্যাত ব্যক্তির ভাস্কর্য তৈরি করেছেন তিনি। তার হাতের ছোঁয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবি কাজী নজরুল ইসলাম, কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, মাদার তেরেসা, বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম, কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, নেলসন মেন্ডলাসহ আরও অনেক গুণী ব্যক্তির ছবি কাঠে ফুটে উঠেছে। আছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যও। পাশাপাশি তার শিল্পকর্মে ফুটে উঠেছে রায়ের বাজার বধ্যভূমির গণহত্যার চিত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কলা গাছের ভেলায় পারাপারের দৃশ্য, দেশের সাতজন শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ, অত্যাচারিত শ্রমিকের আর্তনাদসহ ইত্যাদি।
বাহারুল বলেন, কেউ আমাকে যখন বলে আপনার হাতের তৈরি কাঠের শিল্পকর্ম জাতীয় যাদুঘরে দেখে এলাম, খুবই আনন্দ পাই। যেহেতু আমি শিল্পকর্মটির জন্য সম্মানী নিয়েছি তাই আমার নাম উল্লেখ করা হয়নি। হয়তো আমি একদিন থাকবো না তবে আমার হাতের শিল্পকর্মটি থেকে যাবে। আমার সন্তান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দেখতে পাবে শিল্পকর্মটি এটা ভেবে ভীষণ ভালো লাগে। বগুড়ার শীবগঞ্জ যাদুঘরেও আমার শিল্পকর্ম আছে।
তিনি আরও বলেন, আমি হাতুড়ি-বাটাল দিয়েই সব সময় কাজ করেছি। তাতে অনেক সময় লাগে। এতে একেকটা ভাস্কর্য তৈরি করতে তিন-চার মাস সময় লাগে। ধৈর্য ও পরিশ্রম হিসেবে তেমন মূল্য জোটে না। তবুও নেশাপেশা আর পেটের দায়ে এ ভাস্কর্য তৈরি করি। কিন্তু আর্থিক অসঙ্গতি ও অভাবের কারণে আধুনিক যন্ত্রপাতি কেনা সম্ভব হচ্ছে না। তাহলে সময়ও কম লাগতো।
প্রায় শতাধিক কাঠের ভাস্কর্য তার সংরক্ষণে আছে। এগুলো সরকারিভাবে দেশি ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেন বলেন, সবাই তাকে ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে চেনেন। এ কাজে তার আলাদা কিছু গুণ আছে। সে ছোটবেলা থেকে মূলত আর্টের কাজ করলেও প্রায় ১৭ বছর ধরে কাঠের ভাস্কর্য তৈরি করেন। তবে সে আর্থিকভাবে অসচ্ছল। সরকার বা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সে নিজেকে বড় ভাস্কর্য শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতো।
বাহারুল লতিফের কাছ থেকে কাঠের ভাস্কর্য ও শিল্পকর্ম ক্রয় করা ফরিদপুর শহরের কামরুজ্জামান হীরা, মো. দাউদুজ্জামান দাউদ জাগো নিউজকে বলেন, গাছের শেকড়-বাকড় দিয়ে যে এত সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করা যায়, তা জানা ছিল না। যা তার মেধা ও হাতের গুণ। তার এ শিল্পকর্ম আন্তর্জাতিক মানের। আশা করি একদিন দেশে ছড়িয়ে বিদেশেও তার শিল্পকর্ম পরিচিতি পাবে।
এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লিটন ঢালী জাগো নিউজকে বলেন, তার হাতের কারুকার্য সরাসরি দেখা হয়নি। সময় করে একসময় তার এ শিল্প কর্ম দেখতে যাবো।
সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, তাকে এ বিষয়ে নিয়ম কানুনের ভিত্তিতে সর্বাত্মক সাহায্য সহযোগিতার চেষ্টা করা হবে।
ফরিদপুরের নবাগত জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. কামরুল আহসান তালুকদার জাগো নিউজকে বলেন, আমি সদ্য যোগদান করেছি। এখনো তার বিষয়ে কিছু জানা হয়নি। এরপরও তার সাহায্য সহযোগিতা ও প্রদর্শনীর বিষয়ে তিনি লিখিত আবেদন করলে নিয়ম কানুনের ভিত্তিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হবে। প্রশাসন থেকে বিভিন্ন মেলা ও অনুষ্ঠানে তার এ শিল্পকর্ম তুলে ধরা যে পারে।
এসজে/জেআইএম