কৃষিবর্জ্য থেকে পরিবেশবান্ধব ইট

তানভীর হাসান তানু তানভীর হাসান তানু ঠাকুরগাঁও
প্রকাশিত: ০৩:৫৫ পিএম, ২৮ ডিসেম্বর ২০২২

‘কৃষিবর্জ্য ও মাটি থেকে পরিবেশবান্ধব ইট’ কিভাবে তৈরি করতে হয় এ সংক্রান্ত একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ও রিসার্চ অ্যাসিসটেন্ট আরমান রেজা শাহ্ ও একই বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদিম রেজা খন্দকার। ৭ মাস গবেষণার পর এই সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তারা।

আধুনিক ইমারত নির্মাণে এই পরিবেশবান্ধব ইট সুদূরপ্রসারি ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদী তারা। আরমান রেজা শাহ্ ঠাকুরগাঁও শহরের সরকার পাড়ার অধ্যাপক মো. আব্দুল কুদ্দুস শাহ্’র ছেলে।

jagonews24

ইট উৎপাদনের কথা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি কেটে নেওয়া কিংবা জ্বালানি কাঠ, গাড়ির পুরোনো টায়ার ও রাবার পুড়িয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতির নানা চিত্র। গতানুগতিক এই ধারার বাইরে কৃষিবর্জ্য ও মাটি থেকে পরিবেশবান্ধব ইট তৈরিতে সফলতা অর্জন করেছেন তারা। পোড়ানো ইটের বিকল্প পরিবেশবান্ধব আধুনিক পদ্ধতির ইট হিসেবে এটি পরিচিত হবে- এমনটাই আশা তাদের।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দাবি, কৃষিবর্জ্য ও মাটি দিয়ে তৈরি ইট পোড়ানো ইটের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। এছাড়া সাশ্রয়ীও। আর এই ইটের ওজন অনেক কম হওয়ায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধাও রয়েছে।

গবেষণা বিষয়ে কথা হয় মো. আরমান রেজা শাহ্’র সঙ্গে। তিনি জানান, কোভিড পরিস্থিতির জন্য যখন সারাদেশের সব শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান বন্ধ, অনলাইন সেমিস্টার চলছিল, সেসময়ই মূলত এই গবেষণা করার আগ্রহ জন্ম নেয়। আমি প্রফেসর ড. নাদিম রেজ খন্দকার স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করি এবং স্যার এ বিষয়ে কাজের জন্য আগ্রহ পোষণ করেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে আমি আমার দাদাবাড়িতে (ফুলবাড়ি, দেবীগঞ্জ, পঞ্চগড়) যাই। আমি ছোটবেলা থেকেই এ অঞ্চলে মাটির ঘরের প্রচলন দেখে এসেছি। প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে কাজ শুরু করি।

প্রথম দিকে ওই এলাকার মাটির বাড়িগুলো পরিদর্শন করি এবং এসব বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলি। তারা কী উপকরণ ব্যবহার করেন, তৈরি করতে কী কী সমস্যার সম্মুখীন হন এবং মাটির বাড়ির ব্যবহারের সুবিধা নিয়েও আলোচনা করি। দেখি, এই অঞ্চলে প্রচুর ধানের চাষ হয় এবং ফসল তোলার পর উচ্ছিষ্ট বিশাল একটা অংশ তারা পুড়িয়ে ফেলেন যেটাকে আর কোনোভাবেই ব্যবহার করা হয় না।

jagonews24

সেখান থেকেই চিন্তা আসে, এই বর্জ্য থেকে মাটির বাড়ির জন্য ইট প্রস্তুত করার বিষয়টি। সেখান থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করি (মাটি, কৃষিবর্জ্য)। সেখান থেকেই কয়েকটি রেশিও ধরে ইটের স্যাম্পল প্রস্তুত করে ফেলি। সেগুলোকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ড. নাদিম রেজা স্যারের তত্ত্বাবধানে এই ইটের স্যাম্পলগুলোকে ২৪ ইসিবি, বাংলাদেশ আর্মি ল্যাবে কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ টেস্ট করানো হয়। সেখানে আশাব্যঞ্জক ফল পাই আমরা।

বলে রাখা ভালো, সাধারণ ইটের কম্প্রেসিভ স্ট্রেন্থ ধরা হয় ২১০০ পিএসআই। আমরা ২টি রেশিও থেকে গড় ভ্যালু পাই ১৯০০ পিএসআই এবং ২৪০০ পিএসআই। পরবর্তীতে এই ইটের আরও কিছু স্যাম্পল পিডব্লিউডিতে পাঠানো হয় এবং সেখানেও একই রকম ভ্যালু পাওয়া যায়।

আমদের উদ্দেশ্য হচ্ছে- ১. সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলকে মাথায় রেখে পরিবেশবান্ধব ইন্সট্রাকশন ম্যাটেরিয়াল তৈরি করা। ২. কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানো। ৩. পরিবেশবান্ধব বাসস্থান ব্যবহারে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা।

আমাদের সফলতার মধ্যে রয়েছে-

১. এই ইট প্রস্তুত করতে খরচের পরিমাণ প্রায় শূন্য। ২. যেহেতু এগুলো প্রস্তুত করতে পোড়ানোর প্রয়োজন হয় না, তাই কার্বন নিঃসরণের মাত্রা শূণ্য।
৩. অধিক চাপ নিতে পারার ক্ষমতা থাকায়, গ্রামের মানুষেরা দীর্ঘদিন একটি মানসম্মত বাসস্থানে থাকতে পারবে।
৪. তরুণ সমাজকে গবেষণায় উদ্ভুদ্ধ করা।

jagonews24

তিনি বলেন, এটি কতে গিয়ে আমরা কিছু সমস্যার সম্মখীন হয়েছি। যেহেতু এটি একটি নব্য গবেষণা তাই আমরা এখনই বলবো না এই ইট ১০০% ব্যবহারযোগ্য। আমাদের আরও বিস্তর গবেষণা করতে হবে এবং আমাদের স্পন্সরশিপের প্রয়োজন কমার্শিয়ালি এই ইট প্রস্তুত করে সবার নাগালের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য। তবে ইতোমধ্যেই আমরা এই ইটের ব্যবহার ও বিস্তার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছি এবং সমস্যাগুলোর সমাধান খুব দ্রুত বের করার চেষ্টা করছি।

আরমান রেজা শাহ আরো বলেন, পোড়ানো ইটের শক্তির মাত্রা থেকে মানভেদে কৃষিবর্জ্য ও মাটি দিয়ে তৈরি ইট বেশ শক্তিশালী ও পরিবেশবান্ধব। গবেষণাতেও ভালো ফলাফল পাওয়া গেছে। এই ইটের বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরুর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ড. নাদিম রেজা খন্দকার বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি, কৃষিবর্জ্য ও মাটি দিয়ে তৈরি ইট পোড়ানো ইটের তুলনায় ভালো। কারণ একদিকে এটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় অবদান রেখে পরিবেশ ভালো রাখবে, সেই সঙ্গে কাঁচামালের জোগানও স্থানীয়ভাবে মোকাবিলা করা যাবে।

তিনি আরো বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাটির ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে, কারণ এই ঘরে বসবাস করা বেশ আরামদায়ক। আমরা মানুষকে মাটির ঘর নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করতেই এই গবেষণা করেছি। সফলতাও পেয়েছি। এখন এই ইট বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে অর্থের প্রয়োজন। সরকার আর্থিকভাবে সহযোগিতা করলে কৃষিবর্জ্য থেকে তৈরি এই ইট বাণিজ্যিকভাবে রপ্তানি করাও সম্ভব।

এফএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।