অসাম্প্রদায়িকতার অনন্য নজির

নামাজি আর পূজারি একই দরবারের অনুসারী

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি বরিশাল
প্রকাশিত: ০৫:১৫ পিএম, ১৭ জানুয়ারি ২০২৩

 

এ যেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার এক অনন্য নজির। দরবারের এক জায়গায় কেউ পড়ছেন নামাজ, আরেক জায়গায় কেউ ব্যস্ত পূর্জা-অর্চনায়। একই দরবারে নামাজ ও পূজা-অর্চনা হলেও এ নিয়ে কোনো বিরোধ নেই। কয়েকশ বছর ধরে এ নিয়মানুসারেই চলে আসছে দরবারটি। ইসলাম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পৃথকভাবে তাদের আচার-অনুষ্ঠান পালন করছেন।

বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলার আউলিয়াপুর বারো আউলিয়া দরবার শরিফে এমনই দৃশ্যের দেখা মেলে। যেখানে নামাজিরা নামাজ আদায় ও পূজারিরা পূজা-অর্চনা করেন।

jagonews24

সরেজমিন দেখা গেছে, দরবারজুড়ে বটগাছ। প্রবেশ করতেই হাতের ডান পাশে চোখে পড়ে লম্বা আকৃতির একটি কালো পাথর। পাথরের গায়ে লাল সিঁদুর ও সরিষার তেল মাখানো।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নবদম্পতিরা দরবারে এসে ওই পাথরের গায়ে সিঁদুর ও সরিষার তেল দিয়ে পূজা করেন। উদ্দেশ্য দেবতা শিবের সন্তুষ্টি লাভ। তবে পাথরটি নিয়ে সঠিক কোনো ইতিহাস জানা যায়নি। কেউ এটিকে ‘শিবপাথর’ আবারি কেউ ‘শিবলিঙ্গ’ বলেন। আবার মূল দরবারের পূর্ব পাশেই রয়েছে নারীদের জন্য নামাজ আদায়ের নির্ধারিত স্থান।

jagonews24

আরও পড়ুন: পলিথিন-প্লাস্টিক থেকে তৈরি হবে ডিজেল-বিদ্যুৎ-সার

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রাচীন আমলে দরবারের যে স্থানে মসজিদ ছিল, সেটি এখন বিলীন হয়ে গেছে। স্থানীয়দের ধারণা, বর্তমানে যেখানে ঈদগাহ, সেখানেই ছিল মসজিদ ও ঘাটলা। যদিও এখন নতুন নকশায় আরেকটি দোতলা মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে মূল দরবারে প্রবেশমুখেই।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের রেওয়াজ মেনে পূজা-অর্চনা করে চলে যান। মুসলমানরা নামাজ আদায়, কবর জিয়ারত করেন। দোল পূর্ণিমা, লক্ষ্মী পূর্ণিমা ও অগ্রহায়ণ মাসের ১০ তারিখ উরস বসে।

jagonews24

দরবারের খাদেমরা জানান, বারো আউলিয়ার দরবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সব ধর্মের মানুষের প্রার্থনার জন্য উন্মুক্ত ছিল। এরপর শত শত বছর ধরে চলে আসছে এ নিয়ম। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব বয়সী মানুষ এখানে আসেন উন্নত জীবন লাভের আশায়। এছাড়া সারা বছরই মানতের জিনিসপত্র, টাকা নিয়ে আসেন ভক্তরা।

বাকেরগঞ্জের বারো আউলিয়ার দরবার প্রতিষ্ঠা নিয়ে রয়েছে দুই ধরনের তথ্য। এর মধ্যে সিরাজ উদ্দিন আহমেদের ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘বরিশাল বিভাগের ইতিহাস’-এ সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সে হিসেবে দরবারটি ৩০০ বছরের পুরোনো। অন্যদিকে দরবারে পালিত ৫৬৫তম উরস মাহফিলের হিসাব অনুসারে এটি ১৪৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আরও পড়ুন: টানা ২৬ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন চালক

jagonews24

জনশ্রুতি রয়েছে, তৎকালীন ১২ জন আউলিয়া এসেছিলেন ইসলাম প্রচার করতে। সেই সুবাদে চন্দ্রদ্বীপের রাজা তাদের জন্য উপহার পাঠান। কিছুদিন পর আবার উপহার ফেরত চান রাজা। উপহার দিয়ে ফেরত নেওয়ার এই হীনম্মন্যতা মেনে নিতে পারেননি আউলিয়ারা। তাই সিদ্ধান্ত নেন চলে যাওয়ার।

পরে যাওয়ার সময় তাদের অলৌকিক ক্ষমতায় মাটির সুড়ঙ্গ থেকে সোনা, রূপা, পিতলের থালা, কাপড়, খাদ্যশস্য, জীবন্ত ঘোড়া উগড়ে দিয়ে সেই সুড়ঙ্গ ধরে গায়েব হয়ে যান ১২ আউলিয়া। খবর শুনে রাজা ঘোড়ার বহর ছুটিয়ে আসেন ঘটনাস্থলে। সুড়ঙ্গের চারপাশে তুলে দেন প্রাচীর। এরপর থেকেই এটি ‘বারো আউলিয়ার দরগাহ’ বলে পরিচিতি পায়।

সরেজমিন দেখা যায়, বারো আউলিয়ার দরবার ঘিরে রাখা বটগাছের শেকড়ে ও ডালে অসংখ্য পলিথিন এবং কাপড় বেঁধে রাখা হয়েছে। ভক্তদের বিশ্বাস, মনের আশা পলিথিনে বা কাপড়ে লিখে এই গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখলে তা পূরণ হয়। আবার আশা পূরণ হলে তা নিজ দায়িত্বে খুলে ফেলতে হয়।

jagonews24

ইতিহাস মতে, বারো আউলিয়ার দরবারটি মূলত আউলিয়াদের ধ্যানের জায়গা। দরবারের উত্তর পাশের সুড়ঙ্গ পথে (যে পথে নিরুদ্দেশ হন আউলিয়ারা) দুধ ঢেলে দিতেন ভক্তরা। যা কাছের একটি পুকুরে গিয়ে জমা হতো। সেই পুকুরটিকে বলা হয় ‘দুধ পুকুর’।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আউলিয়ারা চলে যাওয়ার পর স্থানীয় বিখ্যাত দরবেশ ফকির জালাল আরেফিন দরগাহর দেখভাল শুরু করেন। তখন ‘মাছিম শাহ’ নামের একজন পিরের বসবাসের স্থান ছিল ওই দরবার এলাকায়। সেই মাছিম শাহ বারো আউলিয়াদের দক্ষিণাঞ্চলে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। বারো আউলিয়ার দরগায় এই মাছিম শাহের কবর রয়েছে।

আরও পড়ুন: হিমেল হাওয়ায় বিপর্যস্ত জনজীবন

দরবারের খাদেম আব্দুস সালাম ফকির জাগো নিউজকে বলেন, ‘দরবারের মধ্যে যে মাজারটি করা হয়েছে, সেখানে আসলে কারও মরদেহ নেই। এই দরবারে বারো আউলিয়ার কেউ নেই। তারা ইসলাম প্রচার করতে এসেছিলেন। বাদশাহর সঙ্গে দ্বিমতে তারা মাটির সুড়ঙ্গ কেটে মালামাল ফেরত দিয়ে গায়েব হয়ে যান। সেই সুড়ঙ্গের মুখে স্মৃতিস্বরূপ মাজার নির্মাণ করা হয়েছে।’

jagonews24

দরবারের সেবক আব্দুল লতিফ খান বলেন, ‘দরবারে হিন্দুরা হিন্দুদের নীতি পালন করে চলে যান। আর মুসলিমরা আমাদের নিয়ম অনুসারে ধর্মকর্ম পালন করি। একই দরবারে দুই ধর্মের মানুষের প্রার্থনায় কোনো সমস্যা হয় না। এছাড়া সব ধর্মের মানুষ মনের আশা পূরণে গাছের শেকড়ে পলিথিন বা কাপড় গিঁট দেয়। পূরণ হলে তা খুলে ফেলে।’

দরবারের মোতাওয়াল্লি প্রতিনিধি হেলাল উদ্দিন বলেন, দরবার প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বিভিন্ন ধর্মের লোক এখানে আসেন। হিন্দু বা মুসলিম যারাই আসুক, তারা তাদের ধর্মের নিয়ম অনুসারে পালন করে চলে যান।

এসআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।