গৃহবধূ হত্যা মামলায় স্বামীসহ দুইজনের যাবজ্জীবন

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি লক্ষ্মীপুর
প্রকাশিত: ০৫:৪৬ পিএম, ২৮ মার্চ ২০২৩
দণ্ডপ্রাপ্ত সোহেল হোসেন

লক্ষ্মীপুরে বিয়ের চার মাসের মাথায় আয়েশা আক্তার লিপিকে হত্যার দায়ে স্বামী মো. হারুন ও ঘটনার সঙ্গে জড়িত সোহেল হোসেনকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাদের ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা ও অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে।

মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) দুপুরে লক্ষ্মীপুর জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. রহিবুল ইসলাম এ রায় দেন।

এসময় দণ্ডপ্রাপ্ত সোহেল হোসেন আদালতে উপস্থিত থাকলেও ভুক্তভোগীর স্বামী মো. হারুন পলাতক। এছাড়া অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় একই মামলায় নুর মোহাম্মদ ও মো. সোহেলকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।

লক্ষ্মীপুর জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) জসিম উদ্দিন রায়ের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

তিনি বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত দুজনই ১৬৪ ধারায় হত্যার ঘটনা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। সেই সূত্রে তারা দুইজনই অপরাধী। এজন্য আদালত দুইজনকেই সাজা দিয়েছেন।

পিপি জসিম উদ্দিন আরও বলেন, হারুনের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা বেগমকে হত্যার অভিযোগে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থানায় হত্যা মামলা রয়েছে। এছাড়া লক্ষ্মীপুরের কমলনগর, রামগতি ও নোয়াখালীর সুধারাম থানায় আরও পাঁচটি মামলা রয়েছে। হারুন তার দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা বেগমকে হত্যার অভিযোগে কুমিল্লা কারাগারে ২৬ মাস বন্দি ছিলেন।

দণ্ডপ্রাপ্ত হারুন লক্ষ্মীপুরের কমলনগর উপজেলার উত্তর চরকালকিনি গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে ও সোহেল সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরভূতা গ্রামের মো. সিরাজ আনছারের ছেলে।

খালাসপ্রাপ্ত মো. সোহেল লক্ষ্মীপুর পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাঞ্চানগর এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে ও নুর মোহাম্মদ নোয়াখালীর সুধারামপুর থানার এজবালিয়া ইউনিয়নের ধর্মপুর গ্রামের নুর আলমের ছেলে।

আদালত ও এজাহার সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালের ৯ নভেম্বর লক্ষ্মীপুর সদরের তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের চরমনসা গ্রামের ফসলি ক্ষেতের পানির ড্রেন থেকে অজ্ঞাতপরিচয় এক নারীর (২৬) মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। পরিচয় শনাক্ত না হওয়ায় ময়নাতদন্তের পর বেওয়ারিশ হিসেবে মরদেহ দাফন করা হয়। তখন সদর থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) জাহাঙ্গীর আলম বাদী হয়ে মামলা করেন। তিনিই মামলার তদন্তের দায়িত্ব পান।

তদন্তকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে সদরের ভবানীগঞ্জ ইউনিয়নের চরভূতা গ্রামের সোহেল হোসেনকে ও লক্ষ্মীপুর পৌরসভার বাঞ্চানগর এলাকার মো. সোহেলকে আটক করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা পুলিশের কাছে হত্যার দায় স্বীকার করেন।

তারা জানান, ভবানীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের সামনে থেকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ওই নারীকে স্থানীয় মিয়ারবেড়ি এলাকার একটি মৎস্য খামারে নিয়ে যান তারা। পরে তারা তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন। ওই নারী বাঁধা দিলে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে তাকে হত্যার করেন। পরে ড্রেনে মরদেহ ফেলে রেখে চলে যান অভিযুক্তরা। এ ঘটনায় সোহেল হোসেন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে দুইজনকেই অভিযুক্ত করে ২০১৭ সালের ১১ এপ্রিল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। তখনো ওই নারীর পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

ঘটনার সাত মাস পর ২০১৭ সালের জুন মাসে ওই নারীর পরিচয় মেলে। এতে মামলায় নতুন মোড় সৃষ্টি হয়। ওই নারী ছিলেন কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের মিয়াপুরের জগমোহনপুর গ্রামের আসলাম মিয়ার মেয়ে আয়েশা আক্তার লিপি। এতে প্রথমবার আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করলেও পরিচয় শনাক্তের পর ভুক্তভোগীর মা নিলুফা আক্তার মামলাটি পুনর্তদন্তের আবেদন করেন। পরে আদালতের নির্দেশনায় মামলাটি পুনর্তদন্ত করা হয়। পুনরায় তদন্তকালে পুলিশ লিপির স্বামী হারুন ও তার সহযোগী নুর মোহাম্মদকে গ্রেফতার করে। হারুন হত্যার ঘটনা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। ২০১৮ সালের ২১ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোসলেহ উদ্দিন আদালতে হারুনকে প্রধান করে চারজনের বিরুদ্ধে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

তদন্ত প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, হারুন তার দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা বেগমকে হত্যার দায়ে ২৬ মাস কুমিল্লার কারাগারে বন্দি ছিলেন। জামিনে বের হয়ে তিনি কুমিল্লার ইপিজেডের একটি কারখানায় নিরাপত্তাকর্মী পদে চাকরি নেন। কারখানার শ্রমিক লিপির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। এতে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে উঠলে ২০১৬ সালের ৯ জুলাই তারা বিয়ে করে কারখানার পাশেই একটি ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন। এটি দুজনেরই তৃতীয় বিয়ে ছিল। তবে বিয়ের সময় দুজনই নিজেদের অতীত বিষয় গোপন রেখেছিলেন।

কিছুদিন পরই হারুন জানতে পারেন লিপির আগে দুই বিয়ে হয়েছিল এবং পাঁচ বছর ওমানে ছিলেন।

দেশে ফিরে লিপি মোবাইলফোনে বিভিন্ন দেশের পুরুষদের সঙ্গে কথা বলতেন। বিয়ের পরও পরপুরুষের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ হয়নি তার। এতে হারুন নিষেধ করলেও লিপি মানতে নারাজ ছিলেন। এনিয়ে লিপিকে হত্যার জন্য নুর মোহাম্মদকে নিয়ে হারুন পরিকল্পনা করেন। সে অনুযায়ী ৮ নভেম্বর লিপিকে হারুন লক্ষ্মীপুরের তেওয়ারীগঞ্জ ইউনিয়নের আন্ধারমানিক গ্রামে আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়ার কথা বলে সুতারগোপতা এলাকায় নিয়ে আসেন। পথে লিপি অন্য পুরুষের সঙ্গে মোবাইলফোনে কথা বললে হারুনের নিষেধেও তিনি কথা বন্ধ করেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চরমনসা গ্রামের নির্জন এলাকায় নিয়ে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে লিপিকে হত্যার পর মরদেহ ড্রেনে ফেলে রাখে হারুন।

এদিকে, ঘটনার দ্বিতীয় আসামি সোহেল হোসেন পুলিশের কাছে দেওয়া স্বীকারোক্তিতে অজ্ঞাতপরিচয় নারীকে তিনি নিজে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে হত্যা করেছেন মর্মে জবানবন্দি দেন। তবে ঘটনার সঙ্গে হারুনের সম্পৃক্ততার কথা তিনি স্বীকার করেননি। আবার হারুন তার জবানবন্দিতে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি সোহেল জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। এতে তদন্ত কর্মকর্তা তদন্ত প্রতিবেদনে হারুন, সোহেল হোসেন, নুর মোহাম্মদ ও মো. সোহেলের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দীর্ঘ শুনানি ও সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে আদালত হারুন ও সোহেল হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

কাজল কায়েস/এমআরআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।