খেয়ে-না খেয়ে সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন স্বামীহারা জরিনা

শেখ মহসীন
শেখ মহসীন শেখ মহসীন ঈশ্বরদী (পাবনা)
প্রকাশিত: ১১:১৪ এএম, ১৪ মে ২০২৩

তৃতীয় সন্তান গর্ভে থাকা অবস্থায় স্বামীকে হারান জরিনা খাতুন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটির মৃত্যুতে হতভম্ব হয়ে পড়েন জরিনা। এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে স্বামীর ভিটা ছেড়ে আশ্রয় নেন বাবাবাড়ি। স্বামীর মৃত্যুর আটমাস পর জরিনার আরেকটি কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।

তিন সন্তানকে নিয়ে জরিনা খাতুনের শুরু হয় বেঁচে থাকার সংগ্রাম। দিনরাত খেটে তাদের বড় করেছেন তিনি। তার দুই ছেলে-মেয়ে আজ প্রতিষ্ঠিত।

জরিনা খাতুন পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার মুলাডুলি ইউনিয়নের গোয়ালবাথান গ্রামের মৃত হাসান আলীর মেয়ে। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পার্শ্ববর্তী আটঘরিয়ার নাদুরিয়া গ্রামের আব্দুল গণি প্রামানিকের সঙ্গে বিয়ে হয় তার। স্বামী পেশায় ছিলেন চালকলের চালক। ১৯৯৪ সালের ১২ জানুয়ারি চালকলের ফিতা গলায় জড়িয়ে মারা যান তিনি।

সে সময় এক মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন জরিনা। দুই সন্তানের মধ্যে মেয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়তো আর ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পড়তো। মাত্র ২৪ বছর বয়সে স্বামীকে দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদে আশ্রয় নেন বাবাবাড়ি। স্বামীর মৃত্যুর আট মাস পর জরিনা খাতুন কন্যা সন্তানের জন্ম দেন।

is-(5).jpg

দিনে জমিতে দিনমজুরের কাজ করতেন আর রাতে গণশিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে নারীদের পড়াতেন। যা আয় হতো তা দিয়ে খেয়েপড়ে কেটে যায় কয়েক বছর। ইচ্ছা থাকলেও বড় মেয়ে নিহার খাতুনকে খুব বেশি পড়াশুনা করাতে পারেননি। ১৬ বছর বয়সে তাকে বিয়ে দেন। কয়েকবছর পরই সে মারা যায়।

নিহার বিয়ের পর দুই ছেলে-মেয়েকে নিয়ে নতুন করে আশায় বুক বাঁধেন জরিনা। স্বপ্ন দেখেন যেভাবেই হোক দুজনকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করবেন। বাড়িতে গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনের পাশাপাশি একটি উন্নয়ন সংস্থায় মাত্র ৫০ কেজি চাল ও ৩৫০ টাকা মাসিক বেতনে কাজ শুরু করেন। এর মধ্যেই ছুটির দিনগুলোতে তিনি দিনমজুরের কাজ করতেন। দুই ছেলে মেয়েকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দেন।

এখন জরিনা খাতুনের বয়স ৬০ বছর। তার দুই ছেলে-মেয়ে দুজনই স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। ছেলে জিল্লুর রহমান সুজন চাকরির পেছনে না ছুটে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি খুলেছেন একটি কোচিং সেন্টারও। তার প্রতিষ্ঠানে ৮০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এখানে প্রায় ৪০ শিক্ষক-কর্মচারী আছেন।

ছোট মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা স্বপ্না এখন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ছেলে-মেয়ে দুজনেই এখন স্বাবলম্বী। নিরলস পরিশ্রম করে দুই সন্তানকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চ শিক্ষিত করায় ঈশ্বরদী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ২০১৭ সালে তাকে সফল জননী নারী ক্যাটাগরিতে উপজেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পুরস্কার দেওয়া হয়।

জরিনা খাতুন বলেন, কতদিন খেয়ে না খেয়ে ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছি তার কোনো হিসাব নাই। যখন আর কোনো উপায় ছিল না তখন স্বামীর রেখে যাওয়া সর্বশেষ সম্বল ১০ কাঠা জমি বিক্রি করে দিয়েছি। তবু তাদের পড়াশোনা চালিয়ে গেছি।

is-(5).jpg

জরিনা আরও বলেন, আমার ছেলে জিল্লুর রহমান সুজন পাবনা এডওয়ার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্স ও মাস্টার্স করেছে। মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা স্বপ্না পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কে অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স করেছে। তারা দুজনই এখন স্বাবলম্বী। মা হিসেবে এখন আমি তাদের নিয়ে গর্ববোধ করি।

জিল্লুর রহমান সুজন বলেন, মা আমাদের পড়াশোনা করাতে গিয়ে তার জীবনের সব সুখ ত্যাগ করেছেন। পড়াশোনার খরচ যোগাতে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। মায়ের পরিশ্রমের পাশাপাশি নিজেও প্রাইভেট পড়িয়ে পড়াশোনার খরচ যুগিয়েছি। একসময় নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতে গিয়ে অন্যের প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। এখন আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৪০ জন শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। সব কিছুই সম্ভব হয়েছে আমার মায়ের অনুপ্রেরণা ও দৃঢ় মনোবলের জন্য। আমার মায়ের শ্রমে-ঘামের কষ্টের টাকায় পড়াশোনা করেছি বলেই আজ প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছি। আমার জীবনের সব অর্জন মায়ের জন্য।

আয়েশা সিদ্দিকা স্বপ্না বলেন, মা বলতেন পড়াশোনা করে যেন আমি সরকারি চাকরি করি। তাহলে আমাদের দুঃখ কষ্ট একদিন দূর হয়ে যাবে। মায়ের সেই স্বপ্ন আল্লাহ পূরণ করেছেন। পড়াশোনা শেষে আমি দুটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছি। এরপর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক পদে চাকরি পেয়েছি। আমার চাকরির খবর শুনে মা সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন। বর্তমানে আমার শ্বশুরবাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যোগ দিয়েছি।

এসজে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।