সিন্ডিকেটের কবলে ভুট্টা, ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ কৃষক

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি গাইবান্ধা
প্রকাশিত: ১০:০০ এএম, ২৪ মে ২০২৩

‘পনেরো দিন আগেও হাজার টেকায় শুকান ভুট্টা বেচা-বিক্রি হইছে। এলা ব্যাপারীরা ৯০০ টেকাতেও ভুট্টা নেয় না। ভুট্টা বেচপার (বিক্রি করতে) না পাইলে ক্যামন করিয়ে মহাজনের হালখাতা করমো। হামার টেকার দরকার জন্যে ব্যাপারীরা কায়দাত ফেলায়ে কম দামে ভুট্টা কিনবের নাগছে (লাগছে)। ঠেকাত পড়িয়ে কম দামোত ভুট্টা বেচাইনো (বিক্রি করছি)।’

মঙ্গলবার (২৩ মে) সকালে এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন উত্তরের শস্য ভাণ্ডার খ্যাত জনপদ গাইবান্ধার কৃষক আবুল কালাম আজাদ। তিনি জেলার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার বেলকা ইউনিয়নের তালুক বেলকা গ্রামের বাসিন্দা।

ভুট্টা হচ্ছে গাইবান্ধা জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য। অন্য বছরের চেয়ে এবার ভুট্টার ফলনও ভালো হয়েছে। তবে কষ্টের ফসলের ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কিছুটা হতাশ চাষিরা। শুধু ভুট্টা নয়, এ অভিযোগ চরাঞ্চলে উৎপাদিত প্রায় সব পণ্যের ক্ষেত্রে।

জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ, ফুলছড়ি ও সাঘাটার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি ভুট্টার চাষ হয়। এছাড়া সদর, পলাশবাড়ী, সাদুল্লাপুর ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলায়ও সরকারি প্রণোদনার কারণে ভুট্টার চাষ দিন দিন বাড়ছে। চলতি বছর জেলায় প্রায় ১৭ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় ছাড়িয়ে গেছে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও।

ভুট্টা চাষিরা জানান, এ বছর উচ্চমূল্যে সার-বীজ তেল কিনে ভুট্টা চাষ করেছেন। একসময় তিন বেলা খাবারের বিনিময়ে কৃষিকাজ করে নেওয়া যেত শ্রমিকদের কাছ থেকে। কিন্তু বর্তমানের চিত্রটাই ভিন্ন। বাজারের দ্রব্যমূল্য বাড়ার পাশাপাশি বেড়েছে শ্রমের মূল্য। তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি ৫০০-৬০০ টাকা মজুরি দিতে হয়। এতকিছুর পরও বাজারে ভুট্টার দামই নেই। কিন্তু ব্যবসায়ীরা ভুট্টা কিনে গোডাউনে কয়েক মাস রাখার পর বিক্রি করলে তারাই লাভবান হবেন। প্রতিবছর কৃষকরা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হন।

তবে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন এ অঞ্চলের কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্ট সচেতন নাগরিক সমাজ।

সদর উপজেলার মোল্লারচরের কৃষক হাফিজুর রহমান বলেন, ‘দুদিন পর মহাজনের হালখাতা। এজন্য ব্যাপারিক ডাকছি ভুট্টা বেচামো। ব্যাপারীরা যে দাম কয়, সেই দামেই মাল বেচা নাগে। এতো টেকা খরচ করি আবাদ করিও হামরা দাম পাইনে।’

সিন্ডিকেটের কবলে ভুট্টা, ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ কৃষক

বেলকা ইউনিয়নের পঞ্চানন্দ গ্রামের আয়াত আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘ব্যাপারীরা সবাই জোট হইছে। সবাই একদামেই ভুট্টা কিনবের নাগছে (লাগছে)। ব্যাপারীরা ইচ্ছেমতো দাম কমায় আর বাড়ায়। এখন হামরা কৃষকরা এগলে আবাদ করিয়ে মহাবিপদে পড়ছি।’

সদর উপজেলার কামারজানি হাটে ভুট্টা বিক্রি করতে আসা কৃষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘হামরা সরাসরি যদি মাল দিবের পাইনো (পারলে), তাহলে ন্যায্য মূল্য নিয়ে বাড়িত গেইনো হয় (যেতাম)। হামরা তো মনের সুখে আরও বেশি আবাদ করনো হয়। কিন্তু এখানে যেভাবে কার্যকলাপ চলতেছে, এভাবে তো হয় না। হামরা কষ্ট করি পাট, ভুট্টা, ধান আবাদ করি, কিন্তু হামরা তো কোন দাম পাই না। এভাবে হামার ঘরক তো উজার (সর্বস্বান্ত) করবের নাগছে।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েজন ব্যাপারী বলেন, মৌসুমের শুরুর দিকে ভুট্টা ১৩০০-১৪০০ ছিল। ধীরে ধীরে দাম কমতে শুরু করে। মিলে যদি ১০টাকা কমে, আমরা ২৫/৩০ টাকা কমাই। মিলে দাম বাড়লেও আমরা খুব বেশি একটা দাম বাড়াই না। এককভাবে বেশি দামে কিনতেও পারি না।

সিন্ডিকেটের কবলে ভুট্টা, ন্যায্য দাম না পেয়ে হতাশ কৃষক

কামারজানি হাটের মেসার্স আব্দুল লতিফ আড়তের স্বত্বাধিকারী লতিফ মিয়া বলেন, ‘ভুট্টা কাটা-মাড়াইয়ের প্রথম দিকে মণ ছিল ১৪০০ টাকা। এখন ৮৭০-৯০০ টাকা মণ। মিলাররা এখানকার স্থানীয় কয়েকজনকে মাল কেনার দায়িত্ব দেয়। তাদেরই চার-পাঁচ জন এখানে সিন্ডিকেট করে প্রতি মণে ১০০-৩০০ টাকা করে কম দেয়। ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’

এ বিষয়ে কৃষি বিপণন কর্মকর্তা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কৃষি পণ্য এবং কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হলে কৃষিজোন বা কোল্ড স্টোরেজের সংখ্যা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছে সরাসরি কৃষককে পণ্য বিক্রির সুযোগ করে দিতে হবে। এতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ হবে।

গাইবান্ধা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. খোরশেদ আলম জাগো নিউজকে বলেন, গাইবান্ধা জেলার ব্র্যান্ডিং পণ্য ভুট্টার ন্যায্যমূল্য পেতে পরিকল্পিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি। সিন্ডিকেট এবং অবৈধ মজুতদারের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

শামীম সরকার শাহীন/এসজে/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।