ঋণী থাকতে চান না
৬১ বছর পর স্কুলের বেতন পরিশোধ করলেন সোহরাব আলী

৬১ বছর পর স্কুলের বেতন পরিশোধ করলেন সোহরাব আলী নামের এক ব্যবসায়ী। স্কুলে গিয়ে নিজ হাতে ওই টাকা পরিশোধ করেন তিনি। এ ঘটনায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিক্ষকরা।
এমনই ঘটনা ঘটেেছে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার ফুলহরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সোহরাব আলী ১৯৬২ সালে ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ষষ্ট শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। সেই সময়ে বিদ্যালয়ে তার চার মাসের বেতন বাকি পড়েছিল। বেতন দিতে না পেরে দরিদ্র পরিবারের সন্তান সোহরাব স্কুল ছেড়ে দেন। পড়ালেখা ছেড়ে নেমে পড়েন কাজে। হাটে হাটে খোলা জায়গায় তেল-মসলার দোকান বসিয়ে বেচাকেনা করতেন।
জীবনের শেষ সময়ে এসে তার মনে পড়ে আজও তার স্কুলের বেতন বাকি। বিদ্যালয়ের কাছে এখনো তিনি ঋণী। সেই অনুশোচনা থেকে মঙ্গলবার (৬ জুন) ছোটবেলার সেই বিদ্যালয়ে গিয়ে তিনি বেতন পরিশোধ করেন। তখন মাসিক বেতন ছিল চার টাকা। বর্তমান বাজারমূল্য বেশি হওয়ায় ১৬ টাকার পরিবর্তে ৩০০ টাকা জমা দিয়েছেন সোহরাব আলী।
এ বিষয়ে সোহরাব আলীর ভাষ্য, এখনো তিনি সচ্ছল নন, তারপরও ঋণী থাকতে চান না। যে কারণে টাকাটা পরিশোধ করলেন।
সোহরাব আলী ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার মহম্মদপুর গ্রামের মৃত আব্দুল করিম বিশ্বাসের ছেলে। স্ত্রী, দুই মেয়ে আর এক ছেলে রয়েছে তার।
সোহরাব আলী জানান, তার বাবা দরিদ্র ছিলেন। কৃষিকাজ করে তাদের সংসার চলতো। তিনি শিশু অবস্থায় পাশের গ্রাম বড়দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেন। ওই স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে ১৯৬২ সালে বাড়ি থেকে তিন কিলোমিটার দূরে ফুলহরি বাজারে অবস্থিত ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। মাত্র ছয় মাস ক্লাস করেন।
বাবা দরিদ্র হওয়ায় ঠিকমতো পড়ার খরচ দিতে পারতেন না সোহরাব আলী। বিদ্যালয়ে সেই সময়ে মাসিক বেতন ছিল চার টাকা। তার চার মাস বেতন বাকি পড়ে যায়। এ অবস্থায় তিনি লজ্জায় পড়ে যান। তখন পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে কাজে নেমে পড়েন। প্রথম জীবনে বাবার সঙ্গে মাঠে কাজ করেছেন। পরে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন। এরপর বাড়ি এসে ব্যবসা শুরু করেন।
ব্যবসা করা অবস্থায় ১৯৭১ সালে দেশে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ভারতে চলে যান সোহরাব আলী। প্রথম দফায় তিনি রানাঘাট যান, এরপর করিমপুর। সবশেষ তিনি বেতাই ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ নেন। মাত্র কিছুদিন প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেই প্রশিক্ষক হয়ে যান সোহরাব আলী।
দেশ স্বাধীন হলে তিনি বাড়ি ফিরে এসে আবার ব্যবসা শুরু করেন। এভাবে ব্যবসা করে জীবন কাটিয়েছেন। তবে ‘তদবিরের অভাবে’ মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নামটি আসেনি উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন সোহরাব আলী।
সোহরাব আলী বলেন, বয়স প্রায় শেষের দিকে। হঠাৎ একদিন মনে হলো বিদ্যালয়ে তার বেতন বাকি। এখনো তিনি ঋণী রয়েছেন। তিনি ঋণী থাকতে চান না। তাই নিজ উদ্যোগে বিদ্যালয়ে গিয়ে টাকা পরিশোধ করেছেন।
ফুলহরি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক লক্ষণ প্রসাদ সাহা জানান, তাদের এ বিদ্যালয় ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত। সোহরাব আলী ১৯৬২ সালে ভর্তি হন বলে জেনেছেন। যখন সোহরাব আলী বেতন দিতে আসেন তখন অফিসের কাজে তিনি বাইরে ছিলেন।
তিনি আরও বলেন, সোহরাব আলীর সততায় শিক্ষকরা মুগ্ধ হয়েছেন। জমা রসিদ দিয়ে তার টাকাটা গ্রহণ করা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের অফিস সহকারী হাদিকুর রহমান বলেন, তিনি নিজ হাতে টাকাটা গ্রহণ করেছেন।
আব্দুল্লাহ আল মাসুদ/এসআর/জিকেএস