সুনামগঞ্জে অকাল বন্যার ঝুঁকিতে ৫০০ কোটি টাকার ফসল


প্রকাশিত: ০২:৩২ পিএম, ১৪ মার্চ ২০১৬

হাওরাঞ্চল খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার ১১টি উপজেলার ১২০টি হাওরে ২ লাখ ২০ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। ফলও হয়েছে বেশ ভালো। সব ঠিক থাকলে এবার ১৪ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ মেট্রিক টন ধান ঘরে তোলা সম্ভব।

কৃষি অধিদফতরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ হাজার ১২০ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। বলা হয়ে থাকে দেশের প্রায় অর্ধেক খাদ্যশস্য যোগান দিয়ে তাকে হাওরাঞ্চলের এই বোরো ধান।

তবে কৃষকরা শঙ্কিত বহু কষ্টের এই ফসল ঠিকমতো ঘরে তোলা নিয়ে। কারণ প্রায় প্রতি বছরই হাওর রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ সঠিক সময়ে শেষ না হওয়ায় অকাল বন্যায় স্বপ্নের সোনালি এই বোরো ধান তলিয়ে নিয়ে যায়। সঙ্গে তলিয়ে যায় কৃষকের স্বপ্নও।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের দিরাই-শাল্লা উপজেলার বড় ১২ হাওরের ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের সময়সীমা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। ৭৬টি পিআইসির মাধ্যমে বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৪ কোটি টাকারও বেশি। কয়েক দফা সময় বাড়িয়েও কাজ হয়নি ৫০ ভাগ। শুধু এই দুইটি হাওরই নয়, একই অবস্থা পুরো জেলার ১২০টি হাওয়র রক্ষা বাঁধের। এ কারণে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বোরো ধান এখন অকাল বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে পিআইসির সভাপতিরা নিজেদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত কোনো প্রকল্পেই টানানো হয়নি সাইনবোর্ড। এখনও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে বরাম হাওরের তোফানখাড়ি বাঁধ। অর্থভাবে শেষ করা যাচ্ছে না একই হাওরের বোয়ালিয়া বাঁধের কাজ। মাটিকাটার স্থান এখনও জলমগ্ন থাকায় শাল্লা উপজেলার ছায়ার হাওরের জোয়াইরা বাঁধের কাজ ব্যাহত হচ্ছে।

তবে দিরাইয়ে বাধের কাজ তদারকি করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে পৃথক দুটি কমিটি।

স্থানীয়দের অভিযোগ হাওর রক্ষা বাঁধের কাজে পিআইসি ও ঠিকাদাররা অহেতুক সময় ক্ষেপণ করায় হাওরগুলো অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো সময় বৃষ্টি শুরু হলে মাটি কাটার স্থান জলমগ্ন হয়ে পড়বে। তখন কোনোভাবেই আর বাঁধে মাটি কাটা যাবে না। এতে আগাম বন্যার ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে এই উপজেলার শতকোটি টাকার বোরো ফসল।

এ বিষযে পানি উন্নয়ন বোর্ডের এসও মাহমুদুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিটি পিআইসিকে প্রকল্পের নামসহ বরাদ্দের পরিমাণ সম্বলিত সাইনবোর্ড টানানোর জন্য বলা হলেও কেউ তা আমলে নিচ্ছেন না।

তিনি অভিযোগ করেন, টাঙ্গুয়ার হাওরের জাড়লিয়া নদীর তীর ও ঘোড়ামাড়া এবং বরাম হাওরের বোয়ালিয়া ও তোফান খাড়ি বাঁধের কাজে পিআইসির সভাপতিরা তার কোনো দিক নির্দেশনা মানছেন না।  

কালিগুটা, ভেড়ার ডহর ও ছায়ার হাওরের বাঁধের কাজ তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত পাউবো’র উপ-সহকারী প্রকৌশলী (এসও) ইব্রাহিম খলিল অবশ্য দাবি করেন, তার অধীনে ৩২টি পিআইসি রয়েছে। এসব পিআইসির অনুকূলে বাঁধের কাজে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। প্রতিটি বাঁধে গড়ে কাজ হয়েছে ৬৫ ভাগ।

শুধুমাত্র ছায়ার হাওরের শ্রীহাইল এলাকায় জোয়াইরা বাঁধের কাজ বন্ধ রয়েছে। বাঁধের উভয়পাশে পানি থাকায় শ্যালো মেশিন দিয়ে মাটি কাটার স্থান শুকানো হচ্ছে বলে জানান তিনি।   

বরাম, ভাণ্ডা, টাংগুয়া ও উদগল হাওরে ৩২ পিআইসি ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকার বাঁধের কাজ করছে। এসব হাওরে বাঁধের
কাজ তদারকি করছেন পাউবোর এসও মাহমুদুল করিম।

তিনি জানান, এখন পর্যন্ত ২ কিস্তিতে ৪ থেকে ৫০ ভাগ টাকা পিআইসির অনুকূলে ছাড় দেওয়ার পরও বিল না পাবার অযুহাত দেখিয়ে কাজ আটকে রাখা অত্যন্ত দুঃখজনক।

জেলা পাউবোর প্রকৌশল বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাউবোর দিরাই সাব-ডিভিশনের আওতায় ৯ ও জগন্নাথপুর সাব-ডিভিশনের আওতায় ৩টি হাওরে বাঁধের কাজ হচ্ছে দিরাই ও শাল্লা উপজেলায়। এসব হাওরে বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত অংশ পূনরাকৃতি (রি-সেকশনিং) ও অধিকতর নীচু অংশ উচুকরণের জন্য ৭৬ পিআইসির অনুকূলে প্রায় ৪ কোটি টাকা বরাদ্ধ দেয়া হয়েছে। কাজের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে চার কিস্তিতে ওই টাকা ছাড় দেয়া হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাঁধ সংস্কার কাজে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা সম্পৃক্ত থাকলেও এলাকাবাসীর মতামতকে তারা প্রাধান্য দিচ্ছেন না। তবে ইউপি চেয়ারম্যানরা দাবি করছেন, প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করে দেয়া ছাড়া বাঁধের কাজে তাদের আর আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। বরাদ্দ বিভাজন থেকে শুরু করে কোথায় কেমন কাজ হবে তার সবটাই নিয়ন্ত্রণ করেন পাউবোর কর্মকর্তারা।  

বরাম হাওরের বোয়ালিয়া বাঁধের পিআইসির সভাপতি তাড়ল ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য বলেন, এখন পর্যন্ত ২ কিস্তিতে বরাদ্দের ৪৫ ভাগ টাকা তাকে দেয়া হয়েছে। ওই টাকা থেকে কেটে রাখা হয়েছে আনুষাঙ্গিক খরচসহ ভ্যাট-আইটির অর্থ। এখন অর্থাভাবে সময়মতো বাঁধের কাজ করাতে পারছেন না তিনি।

তোফানখাড়ি বাঁধের পিআইসির সভাপতি আবুল হোসেন বলেন, টাকার জন্যে সময়মতো বাঁধের কাজ করাতে না পারায় একদিকে পাউবো আরেকদিকে এলাকাবাসীর গালমন্দ শুনতে হচ্ছে তাকে। বাঁধের কাজে টাকার যোগান দিতে গিয়ে বাপ-দাদার জমি-জমা পর্যন্ত বিক্রি করতে হচ্ছে।

দিরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলতাফ হোসেন বলেন, এখন পর্যন্ত তিনি ১০টি বাঁধ পরিদর্শন করেছেন। গতকাল রোববারও বরাম হাওরের বোয়ালিয়া এবং তোফানখাড়ি বাঁধ পরিদর্শন করে তিনি বলেন, চারদিন আগে এসব বাঁধ যে অবস্থায় ছিল এখনও সেভাবেই আছে।

haur

তিনি আরও বলেন, বাঁধের কাজ তদারকি করতে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৃথক দু’টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। উভয় কমিটিতেই একজন করে এলজিইডির উপ-সহকারী প্রকৌশলী রয়েছেন। ৩/৪ দিনের মধ্যে তারা কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন দাখিল করবেন। প্রতিবেদন পাবার পর বলা যাবে হাওর রক্ষা বাঁধে কি পরিমাণ কাজ হয়েছে।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জের ২২ হাজার ২৫৫ হেক্টর বোরো ধান হুমকির মুখে
এদিকে, নির্ধারিত সময় অতিবাহিত হলেও শেষ হয়নি হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধের নির্মাণ কাজ। ফলে আতঙ্কিত হচ্ছেন এই এলাকার কৃষকরা।

বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ায় দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার দেখার হাওর, সাংহাই হাওর, কাচিভাঁঙ্গা হাওর, জামখলা হাওর ও খাই হাওরের ২২ হাজার ২৫৫ হেক্টর জমির একমাত্র বোরো ফসল হুমকির মুখে রয়েছে।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, দেখার হাওরের হলদির খাড়া, উতারিয়া, পাথারিয়া কোনো কোনো বাঁধের কাজ শেষ। কোনোটির মধ্যপথে, আবার গত বছরগুলোতে বিপদগ্রস্ত যে বাঁধগুলোর অংশ দিয়ে হাওরে পানি ঢুকে সোনালী ফসল তলিয়ে গিয়েছিল এবারো সেই অংশগুলোই হুমকির মধ্যে রয়েছে বলে জানিয়েছেন অনেক কৃষক।

জেলার অধিকাংশ হাওর বাওর, খাল, বিল ও নদী নালায় পলি জমে নাব্যতা হ্রাস পেয়েছে ফলে অল্পবৃষ্টিতে ওই সমস্ত নদী নালা ও বিল ভরে গিয়ে অকাল বন্যায় বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যা পানির প্রথম ধাক্কায় বাঁধগুলো হুমকির মুখে ফেলে দেয়।

পিআইসি’র মাধ্যমে যে কাজগুলো হয়েছে তা বর্তমানে অগোছালো অবস্থায় পড়ে আছে। পাউবোর নিয়ম অনুযায়ী যে মাপের ভিত্তিতে কাজ করার কথা ছিল সে অনুযায়ী কিছু কিছু পিআইসি কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি। সরকার প্রতিবছর ফসল রক্ষা বাধঁ নির্মাণের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিলেও বিগত বছরগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু সুযোগ সন্ধানী দুর্নীতিবাজ কর্মকতা ও ঠিকাদারদের ব্যাপক অনিয়ম-দুনীতির কারণে সময়মতো সুনামগঞ্জ জেলার হাওর ফসলরক্ষা বাঁধ নির্মাণের নামে সময় কালক্ষেপণ করা হচ্ছে। ফলে আগাম বন্যায় কৃষকদের তাদের সোনালী ফসল হারাতে হয়েছিল।

সরকার চলতি বছর নির্ধারিত সময়ে বাঁধ নির্মাণের জন্য টাকা বরাদ্দ দিলেও গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর থেকে বাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয় এবং তা ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জেলার সকল বাঁধের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত করার কথা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাছে ফান্ড না থাকার অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করায় অনেক হাওরে বাঁধ নির্মাণ কাজ বিলম্বিত হয়।

ফলে এখন পর্যন্ত গড়ে ৫০ ভাগ কাজ সম্পন্ন হলেও বাকী কাজ অাদৌ সম্পন্ন হবে কি হবেনা এ নিয়ে হতাশা আর শঙ্কায় রয়েছেন দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার প্রায় পৌনে একলাখ কৃষক। এ নিয়ে কৃষকদের মাঝে সন্দেহ আর প্রচণ্ড ক্ষোভ বিরাজ করছে।

দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার একাধিক কৃষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মাটি কাটার খরচ বাঁচাতে বাঁধের খুব কাছ থেকে মাটি উত্তোলণ করে নির্মাণ করা হচ্ছে বেড়িবাঁধ। অথচ নীতিমালা অনুযায়ী সাধরণ বাঁধের ১০ ফুট, ক্লোজারের ক্ষেত্রে ৩০ ফুট দূরত্বে মাটি উত্তোলনের কথা রয়েছে। পাউবো এসওকে ম্যানেজ করে পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপিমেনটেশন কমিটি) ক্রটিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণ করে অফিস থেকে অনায়াসে বিল উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছেন।

এ ব্যাপারে দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী আবুল কালাম জানান, যেহেতু দক্ষিণ সুনামগঞ্জের কৃষকের একমাত্র ভরসা বোরো ফসল বিধায় প্রত্যেক পিআইসি (প্রজেক্ট ইমপিমেনটেশন কমিটি) ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তাদের প্রতি অনুরোধ দ্রুত বেড়িবাঁধের কাজ সম্পন্ন করার জন্য।

ছামির মাহমুদ/ এমএএস/এবিএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।