পেয়ারার ফলন বিপর্যয়, ৩ কোটি টাকা লোকসানের শঙ্কা

মো. আতিকুর রহমান মো. আতিকুর রহমান ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ০৯:১৭ এএম, ১০ জুলাই ২০২৩

মৌসুমের শুরুতে বৃষ্টি না হওয়ায় ঝরে গেছে ফুল। তাই ফলনও হয়েছে কম। আবার বৃষ্টির অভাবে পরিপক্ব হওয়ার আগেই ঝরে গেছে অনেক পেয়োরা। ফলে ফলন বিপর্যয়ে চাষিদের পাশাপাশি ক্ষতির আশঙ্কা করেছেন ব্যবসায়ীরাও। তাদের চোখে মুখে এখন হতাশার ছাপ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝালকাঠি, বানারিপাড়া ও স্বরূপকাঠি উপজেলার ৫৫ গ্রামে ফলন হয় পেয়ারার। এই এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। আষাঢ়-শ্রাবণের ভরা বর্ষায় এসব এলাকার নদী-খালজুড়ে পেয়ারার সমারোহ। দেরিতে ফুল এলেও বৃষ্টি না হওয়ায় সেই ফুল অনেকটাই ঝরে গেছে। আষাঢ়ের শেষ সময়েও পেয়ারা পরিপক্ব হয়নি।

বিক্রির জন্য এখনো পরিপক্ব হতে আরও ১৫ দিন সময় লাগবে। যে পরিমাণ অর্থ ও শ্রম ব্যয় হয়েছে তাতে আশানুরূপ ফলন না হওয়ায় ৩ কোটি টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন তারা।

jha-(3).jpg

ভিমরুলী, শতদশকাঠী, খাজুরিয়া, ডুমুরিয়া, কাপুড়াকাঠী, জগদীশপুর এলাকা ঘুরে জানা যায়, বিভাগে কম-বেশি সবজায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পেয়ারার চাষ হলেও বরিশাল জেলার বানারীপাড়া, ঝালকাঠি সদর ও পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি ঘিরেই মূলত পেয়ারার বাণিজ্যিক চাষ। বানারীপাড়ার ১৬ গ্রামে ৯৩৭ হেক্টর, ঝালকাঠির ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর, স্বরূপকাঠির ২৬ গ্রামের ৬৪৫ হেক্টর জমিতে পেয়ারা চাষ হয়।

স্থানীয় চাষিরা জানান, প্রায় ২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে বিচ্ছিন্ন আবাদ হলেও ১৯৪০ সাল থেকে শুরু হয়েছে পেয়ারার বাণিজ্যিক আবাদ। এ আবাদ ক্রমশ বাড়ছে। ২০২২ সালে অন্তত ১৯৩২ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিক পেয়ারার আবাদ হয়েছে। এ সময় ফলন হয়েছে প্রায় ২০ হাজার মেট্রিকটন পেয়ারা। কিন্তু এবছর ফলন কম হওয়ায় ১০ হাজার টন পেয়ারা উৎপাদন হবে কিনা তা নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন পেয়ারা চাষিরা।

কৃষক পঙ্কজ বড়াল বলেন, মাঘ-ফাল্গুন মাসে পেয়ারা গাছের গোঁড়া পরিষ্কারের পর সার প্রয়োগ করতে হয়েছে। কাঁদা মাটি দিয়ে গোঁড়া ঢেকে দিয়েছি। তাতে প্রতিটা গাছের গোঁড়ায় গড়ে ৩০০ টাকারও বেশি ব্যয় হয়েছে। পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফুল এসেছিল এবছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় তা অনেকটাই ঝরে গেছে। লাভ তো দূরের কথা, আসল খরচের টাকাই ওঠে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।

ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সরকার কৃষকদের জন্য অনেক কিছুই দেয়। আমি একজন প্রান্তিক ও দরিদ্র কৃষক। সারাদিনই কৃষি নিয়ে পড়ে থাকি। তাই কারও কাছে যেতে না পারায় কৃষি সার ও বীজ কোনো কিছুই পাইনি।

কৃষক দেবব্রত হালদার বিটু বলেন, পেয়ারা আমাদের মৌসুমি আয়ের একমাত্র অবলম্বন। পেয়ারার ফলন ভালো হলে আমাদের সচ্ছলতা আসে। পানির ওপরেই ভাসমান হাটে বছরে কোটি টাকার লেনদেন হয়। অস্থায়ী কিছু দোকান পাট বসে পাইকার, পর্যটক/দর্শনার্থীদের আপ্যায়নের বা ক্ষুধা নিবারণের মাধ্যমে ব্যবসার করে আর্থিকভাবে লাভবান হন বিক্রেতারা। কিন্তু পেয়ারার ফলন কম হওয়ায় পাইকার আগমনসহ সবকিছুতেই এর একটা খারাপ প্রভাব পড়বে।

jha-(3).jpg

তিনি আরও বলেন, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসেই পেয়ারা গাছে ফুল আসতে শুরু করে। তবে বৃষ্টি শুরু না হলে পেয়ারা পরিপক্ব হয় না। জমি ভালো হলে হেক্টর প্রতি ১২-১৪ টন পেয়ারার উৎপাদন হয়। কিন্তু এবছর জ্যৈষ্ঠ মাসে অনাবৃষ্টির কারণে ফুল ঝরে যাওয়ায় পেয়ারার ফলন অনেক কম হয়েছে।

আরেক কৃষক বিপুল চক্রবর্তী বলেন, আমরা সংসারে তিন পুরুষ পেয়ারা বাগানের পরিচর্যাসহ সব ধরনের কাজে নিয়োজিত থাকি। বছরের এ মৌসুমে আমাদের আয় দিয়ে সারাবছর সংসার চলে। এবছর যে ফলন হয়েছে তাতে তিনমাসই সংসার চালানো দুঃসাধ্য হবে। বাকি সময়টাতে কীভাবে চলবো তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।

পর্যটক ব্যবসায়ী নিশিথ হালদার বলেন, পেয়ারা মৌসুমকে ঘিরে দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক আসেন। আগে শুধুমাত্র নৌপথে আসতেন। এখন পদ্মা সেতুর সুবাদে সড়ক পথেও আসছেন। পর্যটকদের সংখ্যাও গতবছর থেকে বেড়েছে। পেয়ারা চাষিদের বাগানে ঢুকে ক্ষতি সাধন হওয়ায় আমরা পেয়ারা বাগানে নান্দনিক ভ্রমণের সুযোগ করেছি। কিন্তু এবছর যেভাবে পেয়ারার ফলন তাতে তেমন পর্যটক বা দর্শনার্থীরা আসবেন বলে মনে হয় না। কারণ পর্যটক বা দর্শনার্থীরা ফেরার সময় কিছু পরিমাণ পেয়ারা কিনে নিয়ে যান। পেয়ারার ফলন কম হওয়ায় সবদিক থেকেই লোকসানের মুখে পড়বে এখানকার লোকজন।

পেয়ারা চাষি ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ভবেন হালদার জাগো নিউজকে বলেন, কৃষির ফলনে সবচেয়ে সুবিধাজনক হলো স্বাভাবিক মাত্রায় বৃষ্টি। কিন্তু এবছর পেয়ারা গাছের পরিচর্যা সঠিকভাবে করা হলেও বৃষ্টি না থাকায় যে পরিমাণে ফুল এসেছিলো তার বেশিরভাগই ঝরে গেছে। এখন পেয়ারা গাছে যে পরিমাণ ফল আছে তাতে খরচ পোষানোই দুঃসাধ্য ব্যাপার। ধারণা করছি সবমিলিয়ে এবছর পেয়ারা চাষিদের ৩ কোটি টাকারও বেশি লোকসান হবে।

ঝালকাঠি কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ঝালকাঠি সদর উপজেলায় ১৩ গ্রামে ৩৫০ হেক্টর জমিতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ হয়। পেয়ারা মৌসুমে এলাকার হাজার হাজার মানুষের কাছে ‘পেয়ারা’ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য ও জীবিকার অবলম্বন। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় ফুল কিছুটা ঝরে গেছে।

এসজে/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।