খাবার-ভবন নিয়ে ভুগছে ঝালকাঠি সরকারি শিশু পরিবার

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি ঝালকাঠি
প্রকাশিত: ০৭:৫৮ পিএম, ০২ আগস্ট ২০২৩

নানা সমস্যায় জর্জরিত ঝালকাঠি সরকারি শিশু পরিবার বা শিশু সদন। এখানকার শিশুদের তিনবেলা পুষ্টিকর খাবার সরবরাহের কথা থাকলেও তা করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিদিন দুপুরের খাবারে মাছ, মাংস বা ডিম দেওয়ার কথা থাকলেও শিশুদের কপালে জুটছে কেবল সবজি।

এছাড়া শিশু সদনটির ভবনেরও বেহাল দশা। চারতলা ভবনটির ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। এতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে।

jagonews24

তবে শিশু সদনটির খাবারের ঠিকাদার বলছেন, বর্তমান বাজার দরের তুলনায় বরাদ্দ কম খুবই হওয়ায় তাকে লোকসান দিয়ে খাবার সরবরাহ করতে হয়। তাই বরাদ্দ না বাড়ালে খাবারের মান বাড়ানো সম্ভব না। আর ভবনের বেহাল দশার বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি বলে দাবি ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগের।

আরও পড়ুন: নানা সঙ্কটে কুমিল্লার সরকারি বালিকা শিশু পরিবার

শিশুসদন সূত্রে জানা যায়, নিবাসের প্রতিটি শিশুর জন্য প্রতিদিন তিনবেলা খাবার ও দুইবার নাশতা খরচ বাবদ মাসিক বরাদ্দ মাত্র তিন হাজার টাকা। উল্লিখিত বরাদ্দ থেকে ভ্যাট এবং ঠিকাদারের লাভের অংশ বাদ দিয়ে মাসে শিশুদের জন্য থাকে দুই হাজার টাকার মতো। এ হিসাবে প্রতিবেলায় খাবার খরচ মাত্র ২৩ টাকা। এতে তালিকা অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার সরবরাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। এছাড়া ঠিকাদারকে বিশেষ বা বার্ষিক উৎসবের দিনগুলোতে শিশুদের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করতে হচ্ছে ধারদেনা করে।

গত ১৯ ও ২০ জুলাই শিশু পরিবারে গিয়ে কথা বলে জানা যায়, প্রায়দিনই তাদের ডিম আর সস্তা সবজি দিয়ে খেতে হচ্ছে। তবে কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া তাদের কথা না বলতেও সতর্ক করা হয়েছে। যে কারণে খাবারসহ অন্য কোনো সমস্যার কথা বলতেও কেউ রাজি নয়।

গত ১৯ জুলাই দুপুর ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, দুপুরে শিশুদের জন্য পাঙাস মাছ ও ডাল রান্না করা হয়েছে। তবে ওইদিন দুপুরে সদনের স্টাফরা তাদের জন্য মুরগি রান্না করেছিলেন। ঝালকাঠি সদরের বাসন্ডা ইউনিয়নের এক শিশু জানায়, ১৯ জুলাই রাতে এবং সকালে কুমড়ার সবজি দিয়ে ভাত খেয়েছে তারা।

২০ জুলাই দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, চাল-ডাল দিয়ে খিচুরি রান্না করা হয়েছে। পৃথকভাবে সামান্য পরিমাণে ব্রয়লার মুরগি রান্না করে রাখা হয়েছে। তাতে দেখে মনে হয়েছে, সর্বোচ্চ দুই টুকরা মাংসের বেশি কেউ পাবে না। বর্তমানে এ নিবাসে ৭০ থেকে ৭৫ জন শিশু আছে বলে কর্তব্যরতরা জানান।

বাবুর্চি মো. মিঠু জানান, তার সহযোগী বাবুর্চিকে প্রেষণে ষাটপাকিয়া অন্ধ স্কুলে পাঠানোর কারণে তাকে রান্নার কাজে শিশু পরিবারের সদস্যরাই সহায়তা করে। এখানে জনবল সংকট দীর্ঘদিনের সমস্যা।

আরও পড়ুন: জনবল সংকটে খুঁড়িয়ে চলছে নওগাঁ শিশু পরিবার

jagonews24

এদিকে, ১৯৯৯ সালে নির্মিত সরকারি এ শিশু পরিবারের চারতলা ভবনটিও মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানায় বাসিন্দারা। ভবনের ভেতরে ঘুরে দেখা গেছে, ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ফাটল। কোনো কোনো কক্ষের ছাদ থেকে বালু খসে পড়ায় কাপড় টানিয়ে নিচে বসবাস করছে শিশুরা।

এ বিষয়ে চতুর্থ তলার দুই নম্বর রুমের শিশুদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অহরহ বালু ও পলেস্তারা খসে পড়ায় তারা আতঙ্কে আছে। নষ্ট হচ্ছে তাদের জামা কাপড় এবং বিছানা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ এ ভবনটি নিয়ে তারাও দুশ্চিন্তায় আছেন। এছাড়া উপ-তত্ত্বাবধায়কসহ মোট ২১টির মধ্যে ১৩টি পদে লোকবল আছে।

প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বরাদ্দে কিভাবে খাবার সরবরাহ করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে সদনের ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন বলেন, আমি লোকসান দিয়ে খাবার সরবরাহ করছি। কারণ, আমি যে দরে এখানে খাবার সরবরাহের কাজ পেয়েছি, বাজারদর তার চেয়ে বেশি। এতে আমার প্রতিমাসে ২৫/৩০ হাজার টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। আমি এবার টেন্ডার দিতে না চাইলেও কর্তৃপক্ষের অনুরোধে দিয়েছি।

তিনি বলেন, প্রাইভেট এতিমখানা, হাসপাতালসহ সবখানে খাবারের বরাদ্দ বাড়ানো হলেও এখানে বাড়েনি। জনপ্রতি মাসে তিন হাজারের পরিবর্তে এখন চার হাজার টাকা করা দরকার। এ টাকায় প্রতিদিন সকালের নাশতা, দুপুরে দুইদিন মুরগি, দুইদিন ডিম ও দুইদিন মাছ দিতে হয়। এরপর বিকেলে নাশতায় দুধ-মুড়ি, রাতে আবার ভাত। একই বরাদ্দ থেকে জ্বালানি, ভ্যাটের টাকা কেটে আবার বিশেষ দিনের খাবারও দিতে হচ্ছে। এসব দিনের খাবারের জন্য আলাদা কোনো বরাদ্দ না দেওয়ায় ওদের খাবারের টাকা দিয়েই খরচ করতে হয়। তাই এতে না হওয়ায় ধারদেনা করে খাবার সরবরাহ করতে হচ্ছে।

jagonews24

এ বিষয়ে ঝালকাঠি সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুর রশিদ খান বলেন, শিশু পরিবারে ঠিকাদার টেন্ডার অনুযায়ী খাদ্য সরবরাহ করবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ, বাজারদর যাই থাকুক টেন্ডারে যে দর উল্লেখ করেছেন সেই দরে নির্ধারিত খাবার সরবরাহ করতে হবে তাকে।

শিশু পরিবারের উপ-তত্ত্বাবধায়ক খান জসিম উদ্দিন বলেন, বরাদ্দ তিন হাজার টাকায় যে মেন্যু আসে সেভাবে তাদের খাবার সরবরাহ করা হয়। কিন্তু তিন হাজার টাকা থেকে ভ্যাট ও ঠিকাদারের লাভ নেওয়ার পর অবশিষ্ট টাকায় মাছ, মাংস, ডিম খাওয়ানো সম্ভব কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার যেভাবে যা বরাদ্দ দেন আমরা সেভাবে ম্যানেজ করে খাওয়ানোর চেষ্টা করছি। তবে প্রতিদিন সবজি দেওয়ার কথা তিনি স্বীকার করেন।

আরও পড়ুন: সমস্যায় জর্জরিত রাজশাহী শিশু পরিবার

ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফয়সাল আলম বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না বা এটি সংস্কার করার প্রয়োজনীয়তা আছে কি না এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষ আমাকে কিছুই জানায়নি। তারা নিজেরাই সংস্কার কাজ করিয়ে নিচ্ছে। তারা চাহিদাপত্র পাঠালে আমি বরাদ্দের জন্য চিঠি লিখতে পারি।

এদিকে, ঝালকাঠি শিশু পরিবারে খাবারে অনিয়ম ও নিম্নমানের খাবার দেওয়ার বিষয়ে তদন্ত কমিটি করেছে বিভাগীয় সমাজ সেবা অধিদপ্তর। বরিশাল বিভাগীয় সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ও ঝালকাঠির সাবেক ডিডি স্বপন কুমার মুখার্জিকে এ তদন্তের দায়িত্বভার দেওয়া হয়। ঝালকাঠি সরকারি শিশু পরিবারের তত্ত্বাবধায়ক জসিম উদ্দিন খান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

মো. আতিকুর রহমান/এমআরআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।