একাত্তরের যুদ্ধবিভীষিকা দেখালো ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি যশোর
প্রকাশিত: ১২:৪৪ পিএম, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

শত শত মানুষ দলবেঁধে হাঁটছে। এ হাঁটা যেন অজানা এক গন্তব্যের দিকে। কেউ তার বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে তুলে হাঁটছেন। আবার কেউ সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে নিয়ে নিজেদের শেষ সম্বল নিয়ে অজানা ভবিষ্যতের দিকে যাচ্ছেন। দলবেঁধে এ যাত্রা ক্রমেই এগিয়ে যাচ্ছে যশোর রোড ধরে ভারতের আশ্রয় শিবিরে। একাত্তরের যুদ্ধবিভীষিকায় শরণার্থীদের এই দুর্দশার চিত্র শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) প্রতীকী পদযাত্রায় তুলে এনেছিলেন পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী।

১৯৭১ সালের যশোর রোডের ইতিহাসকে ৫২ বছর পর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে ফিরিয়ে এনেছিল যশোর জেলা প্রশাসন। ‘স্মরণে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-৭১’ শীর্ষক দুইদিনের অনুষ্ঠানে শুক্রবার যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহের প্রতীকী মঞ্চায়ন করা হয়। এই আয়োজনের মধ্যে দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’কে মূর্ত করে তোলা হয়।

শুক্রবার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত যশোর রোডের পুলেরহাট বাজার থেকে কৃষ্ণবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত ‘স্মরণে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-৭১’ স্মৃতিচারণের আয়োজন করে জেলা প্রশাসন। প্রায় ২৫ মিনিটে এক কিলোমিটার এ যাত্রায় যুদ্ধকালীন যশোর রোডের শরণার্থীদের যুদ্ধবিভীষিকা, অবর্ণনীয় দুর্দশা ফুটে ওঠে। ৫২ বছর আগের প্রতীকী স্মৃতিচারণে একদিকে যেমন অনেকের হৃদয়ে শিহরণ জাগিয়েছে; অন্যদিক আবেগতাড়িতও হয়েছেন অনেকে। আর বর্তমান প্রজন্ম দেখেছে দুর্দশা-যুদ্ধ বিভীষিকার খণ্ডচিত্র। সড়কের দুপাশে বিভিন্ন বয়সী মানুষও দেখেছেন এই প্রতীকী পদযাত্রা। সবারই গা শিউরে উঠেছে এই দৃশ্যপটে।

Jess-4.jpg

শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটায় শুরু হয় যশোর রোডের এই প্রতীকী পদযাত্রা। শহরতলী পুলেরহাট বাজার থেকে শুরু হওয়া প্রতীকী উপস্থাপনাতে পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী যশোর রোডে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র ঘটনাপ্রবাহ ফুটিয়ে তোলেন। কাঁধে করে এক বৃদ্ধকে তার ছেলে নিয়ে যাচ্ছিলেন আশ্রয় শিবিরে। যাওয়ার পথে পাকিস্তানি মিলিটারিদের ভয়ে নিজের প্রাণ বাঁচাতে সেই বৃদ্ধ বাবাকে ফেলে রেখে যান গাছের নিচে। পরবর্তীতে একটি শিয়াল সেই বৃদ্ধের অসাড় দেহটির বিভিন্ন অংশ খেয়ে ফেলে। আবার একমাত্র সন্তানের মরদেহ নিয়ে হেঁটে চলার দৃশ্যও ফুটে ওঠে। শতশত ক্ষুধার্ত শরণার্থীকে খাবার দিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। অনেকেই নিজের শেষ সম্বল পোটলা বেঁধে হেঁটে চলার দৃশ্যও দেখা গেছে। কেউ বা স্ত্রী-সন্তান হারিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় বেঁচে থাকা অবলা প্রাণী ছাগলটিকে শেষ সম্বল মনে করে তা নিয়েই হেঁটে চলেছেন। আবার মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যেভাবে তার ক্যামেরায় এইসব শরণার্থীর অবর্ণনীয় দুর্দশার চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন; সেই দৃশ্যও দেখা গেছে।

এই প্রতীকী পদযাত্রা উপস্থাপনাতে অংশ নিয়েছিলেন অনুসূয়া নামে এক সাংস্কৃতিক কর্মী। তিনি বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। বাবা-মায়ের মুখে শুনেছি। অভিনয়ে যুদ্ধকালীন শরণার্থীদের যে দুর্দশা তার কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। সে এক অসাধারণ সময়ের সাক্ষী হয়ে গেলাম।

Jess-4.jpg

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশের মানুষের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার খবর বিশ্ববাসীর কাছে পোঁছে দিয়েছিলেন মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ। তার চরিত্রায়ন করেছেন যশোরের সাংস্কৃতিক কর্মী শফিকুল আলম পারভেজ। তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ১৯৭১ সালে যুদ্ধকালীন যশোর রোডের শরণার্থীদের যুদ্ধবিভীষিকা, অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র নিয়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এটি শুধু একটি কবিতা নয়, বাঙালির আত্মত্যাগের একটি মূল্যবান উপাখ্যানও। তার সেই চরিত্রটি সেভাবে করতে পারিনি। তবে তার সেই চরিত্র করতে গিয়ে আমি যেন একাত্তরেই ফিরে গিয়েছিলাম।

এই প্রতীকী পদযাত্রা নির্দেশক থিয়েটার ক্যানভাসের কর্ণধার কামরুল হাসান রিপন বলেন, পাঁচ শতাধিক সাংস্কৃতিক কর্মী ও বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা সেপ্টেম্বর অন যশোর রোডের গৌরবোজ্জ্বল প্রতীকী স্মৃতিচারণে অংশ নেন। এই সড়কের শুরু থেকে শেষ স্থান কৃষ্ণবাটি গ্রাম পর্যন্ত তারা নিজ নিজ চরিত্রে ডুবে ছিলেন। ২০২৩ সালের আজকের এই দিনটা যেন সবাই ফিরে গিয়েছিলেন ১৯৭১ সালের সেই সেপ্টেম্বর মাসে।

যশোর সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার আফজাল হোসেন দুদুল বলেন, একাত্তরে আমরাও এই সড়ক দিয়ে ওপারে গেছিলাম। সেই দৃশ্য আমাদের চোখে আজও ভেসে ওঠে। প্রতীকী যাত্রা আর সুনিপুণ অভিনয়ে সেই দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেলো।

Jess-4.jpg

পদযাত্রা শেষে স্থানীয় কৃষ্ণবাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন স্থানীয় সরকার, পল্লী ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টচার্য। তিনি বলেন, ঐতিহাসিক যশোর রোড মুক্তিযুদ্ধের একটি অংশ। এই রোড ঘিরে আছে অনেক গল্প-গান। মুক্তিযুদ্ধে লাখো মানুষ জীবন বাঁচাতে এই পথ দিয়েই ভারতে আশ্রয় নেন। অবর্ণনীয় দুর্দশা ও যুদ্ধচিত্র নিয়ে মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ রচনা করেছিলেন কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। এই কবিতাটি পড়লে বর্বর পাকিস্তানিদের নির্মম নৃশংস গণহত্যার চিত্র যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে। জেলা প্রশাসনের এই আয়োজনে নতুন প্রজন্ম তাদের ইতিহাসকে নতুনভাবে জানতে পারলো। প্রতিবছরই এভাবে আমরা সেই ঐতিহাসিক রোডকে স্মরণ করতে চাই। সেইসঙ্গে এই রোডকে সংরক্ষণে আমরা পদক্ষেপ নেবো।

যশোরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবরাউল হাছান মজুমদার বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যশোর রোডের নাম জড়িয়ে রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্র বাহিনীর সদস্যরা এই যশোর রোড দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। আবার এই সড়ক দিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ ভারতে শরণার্থী হয়ে ছুটতে থাকেন। মার্কিন কবি এ নিয়ে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামে একটি কবিতাও লিখেছিলেন, যেটি সারা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানাতে ও সড়কটিকে স্মরণ করতে এই আয়োজন।

মিলন রহমান/এমআরআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।