বাদক দলে মুখরিত ৫০০ বছরের পুরোনো হাট
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে ঢাকের হাট বসেছে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে। ঢাক-ঢোল ছাড়াও নানা ধরনের বাদ্যযন্ত্রের দেখা মেলে এ হাটে। নাম ঢাকের হাট হলেও এখানে ঢাক কিংবা বাদ্যযন্ত্র কেনাবেচা হয় না। বাদকরা অর্থের বিনিময়ে পূজা চলাকালে আয়োজকদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। কার চুক্তিমূল্য কত হবে, তা নির্ধারণ হয় বাদকদের দক্ষতার ওপর।
পূজো কমিটির কর্তারা যাচাই করে নেন বাদকদের দক্ষতা। তাই ৫০০ বছরের পুরনো এ হাটে দেশের দূরদূরান্ত থেকে আগত বাদ্যদলকে ভাড়া করতে ভিড় করছেন বিভিন্ন এলাকার পূজার আয়োজকরা। আর তাদের নিরাপত্তায় সতর্ক ভূমিকা পালন করেছে এলাকাবাসী ও পুলিশ।
বুধবার (১৮ অক্টোবর) থেকে শুরু হওয়া এ হাট চলবে শনিবার (২০ অক্টোবর) সকাল পর্যন্ত। প্রায় পাঁচশো বছরের পুরনো এ ঢাকের হাটে ঢাক-ঢোল, কাঁসর, সানাই, বাঁশি, কর্তাল, খঞ্জরিসহ বাঙালির চিরচেনা সব বাদ্যযন্ত্রের পসরা সাজিয়ে বসেন বাদক দল। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা এসব বাদক দলকে পূজা মণ্ডপের জন্য ভাড়া করতেও বিভিন্ন এলাকার পূজা আয়োজকর ভিড় করেন। ১০ হাজার থেকে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ভাড়ায় মিলছে এসব বাদক দল। পাশেই পূজার ফুল পদ্মের পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা।

যখন দুর্গা দেবীকে বরণে পূজা মণ্ডপগুলোর প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে, তখন ভালো বাদ্যদলের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হতে পূজারিরা ছুটছেন এ হাটে। কেননা, ঢাক-ঢোলের বাদ্যি ছাড়া দেবীর আরাধনাই যেন পূর্ণ হয় না। মহাষষ্ঠী থেকে বিসর্জন সবখানেই দেবী তুষ্টির জন্য চাই সুর আর তালের ব্যঞ্জনা।
দুর্গত নাশিনী মা দুর্গা দেবীকে নিজ আসনে বসানোর আগেই চুক্তিবদ্ধ হয়ে এসব বাদক দল চলে যাচ্ছে কিশোরগঞ্জসহ আশপাশের জেলার বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে। দেবী তুষ্টির জন্য শুরু হবে তাদের তাল ও সুরের শৈল্পিক আয়োজন।
জনশ্রুতি আছে, ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে স্থানীয় সামন্ত রাজা নবরঙ্গ রায় তার রাজপ্রাসাদে দুর্গাপূজার আয়োজন করতেন। কটিয়াদীর চারিপাড়া গ্রামে ছিল রাজার প্রাসাদ। একবার রাজা নবরঙ্গ রায় সেরা বাদকদের সন্ধান করতে ঢাকার বিক্রমপুরের (বর্তমানে মুন্সিগঞ্জ) বিভিন্ন স্থানে আমন্ত্রণ জানিয়ে বার্তা পাঠান।
সে সময় নৌপথে অসংখ্য বাদক দল পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে যাত্রাঘাটে সমবেত হন। রাজা নিজে দাঁড়িয়ে একে একে বাজনা শুনে সেরা দলটি বেছে নিতেন এবং পুরস্কৃত করতেন। সেই থেকে যাত্রাঘাটে ঢাকের হাটের প্রচলন শুরু হয়। পরে এ হাট স্থানান্তর করে কটিয়াদীর পুরাতন বাজারের মাছ মহাল এলাকায় আনা হয়।
বাদক ও বাদ্যযন্ত্রের হাট ছাপিয়ে এটি এখন বাঙালির ঐতিহ্য ও মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। ‘তাক দুম, তাক দুম বাজে বাংলাদেশের ঢোলের’ অপূর্ব বাদ্য মূর্ছনায় মুখরিত হয়ে ওঠে আড়িয়াল খাঁ নদী পাড়ের এ প্রাচীন জনপদ।
গাজীপুরের কাপাসিয়া থেকে সাতজনের বাদক দল নিয়ে এসেছেন সুক্তান চন্দ্র মনি দাস। তিনি বলেন, পূজায় সবাই আনন্দ করে। কিন্তু আমাদের চলে আসতে হয় পরিবার ছেড়ে। বংশ পরম্পরায় এটি হয়ে এসেছে। নিজের পরিবারের মুখে হাসি ফোটাতে চলে আসি এ হাটে। আশা ঢাক বাজিয়ে পরিবারের জন্য নতুন কাপড় নিয়ে যাওয়ার। এবার হাটে ভালো টাকা বায়না পাবো আশা করছি।

হবিগঞ্জ থেকে বাদ্যদল নিয়ে এসেছেন মাদব কুমার ঘোষ। তিনি বলেন, এটা আমাদের ব্যবসা। তাই মুসলমান হয়েও মণ্ডপে বাদ্যবাজিয়ে জীবন চালাই। এখনো বায়না হয়নি। আশা করছি দেড় লাখ টাকা হলে বায়নায় যাবো।
জেলার তাড়াইল উপজেলা থেকে বাদ্যদল বায়না করতে এসেছেন নিরঞ্জন সরকার। তিনি বলেন, হাট থেকে প্রতিবছরই দুর্গাপূজার জন্য ঢাক-ঢোল বায়না করে নিয়ে যাই। এবারও এসেছি। তবে এবার বাদক দলের দাম বেশি।
নরসিংদী থেকে বাদক দল ভাড়া করতে এসেছেন তপন রায়। ৬০ হাজার টাকায় দল ঠিক করেছেন। বলেন, প্রতি বছর এ হাট থেকেই ঢাকি নিয়ে যাই। ঘুরে ঘুরে বাজনা শুনেছি। একটি দলের সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। হাটটা বেশ উপভোগও করি আমি।
কটিয়াদী ঢাকের হাট পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক তপন কুমার ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, শারদীয় দুর্গোৎসবকে সামনে রেখে এ বাদ্যযন্ত্রের হাট বসলেও চিরচেনা তাল ও সুরের প্রদর্শনের মহড়ায় প্রকৃত পক্ষে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালির মিলন মেলায় পরিণত হয়। সব ধর্মের লোকজনই হয়ে ওঠে ওদের রক্ষাকবচ। হাটে বাদ্য দলের জন্য থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাসহ সব সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
কটিয়াদী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম শাহদাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, পূজার আয়োজক ও বাদকদের নিরাপত্তার জন্য কটিয়াদী মডেল থানা পুলিশ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকের হাটে পুলিশের একটি দল কাজ করছে।
এসজে/জিকেএস