ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট এবার ডাক্তার

রোগী সেজে ভুয়া চিকিৎসক ধরলেন সাংবাদিক

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক বগুড়া
প্রকাশিত: ০৯:২৭ পিএম, ৩১ জানুয়ারি ২০২৪

এমবিবিএস চিকিৎসক হওয়ার জন্য কোনো ডিগ্রিই নেই তার। তবুও তিনি চিকিৎসক। বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত রোগী দেখেন। পরিচয় দেন বগুড়ার ২৫০ শয্যা সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে।

মঙ্গলবার (৩০ জানুয়ারি) এ প্রতিবেদকের কাছে তার প্রতারণার বিষয়টি ধরা পড়ে। কর্তৃপক্ষ বলছে, হাসপাতালটিতে এ ধরনের কোনো পদবি নেই।

ভুয়া ওই চিকিৎসকের নাম সঞ্জয় কুমার দেবনাথ। এর আগে গতবছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি বগুড়ার দুপচাঁচিয়ায় ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট সেজে গ্রেফতার হয়েছিলেন তিনি। ওইসময় পুলিশ বাদী হয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতারণার মামলা করেছিল। পরে জামিনে বের হয়ে বগুড়া সদরের ফণিরমোড় এলাকায় আরাদ্ধা মেডিকেল হল খুলে বসেছেন। নিজের নাম পরিবর্তন করে রেখেছেন ‘সঞ্জয় চন্দ্র দেব’।

ডাক্তারি বিদ্যা পাস না করেও নামের আগে ‘ডাক্তার’ লিখে ওই চেম্বারে বসে মা ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ পরিচয়ে গত দুই মাস ধরে নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এখানে যেসব মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন তারা নিতান্তই গরিব ও অশিক্ষিত। তাই অতি সহজেই এ মানুষদের কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা কামিয়ে নিচ্ছেন সঞ্জয়।

মঙ্গলবার রাতে রোগী সেজে তার চেম্বারে প্রবেশ করেন এ প্রতিবেদক। সদর উপজেলার ফণিরমোড়ে মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে চেম্বার খুলে বসেছেন সঞ্জয়। হাঁপানি সমস্যা জানাতেই বুকে স্টেথোস্কোপ ঠেকিয়ে তিনি শ্বাসপ্রশ্বাস পরীক্ষা করলেন। এরপর প্রতিবেদককে পরামর্শ দিলেন এক্স-রেসহ কিছু পরীক্ষা করিয়ে দেখা করার জন্য। তাকে দেখানোর ভিজিট চাইলেন ৩০০ টাকা। এসময় তাকে গতবছর ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট সেজে গ্রেফতার হওয়ার প্রতিবেদনটি দেখানো হলে তিনি নড়েচড়ে বসেন। কিছুটা সময় নিয়ে সঞ্জয় বলেন, গতবছর গ্রেফতারের বিষয়টি ছিল ভুল বোঝাবুঝি। পরে এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনও করেছি।

jagonews24

তিনি আরও জানান, বর্তমানে ২৫০ শয্যা সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তার সামনেই হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শফিক আমিন কাজলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হয়। এসময় ওই চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালটিতে উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার বলতে কোনো পদ নেই। এছাড়া সঞ্জয় চন্দ্র দেব নামের কোনো চিকিৎসকও সেখানে কর্মরত নেই। কেউ এ ধরনের পরিচয় ব্যবহার করে থাকলে তিনি ভুয়া।

এরপর সঞ্জয় নিজেকে সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালের ‘ডাক্তার’ প্রমাণ করতে বগুড়ার সিভিল সার্জন ডা. শফিউল আজম সই করা আদেশপত্র বের করেন। গত ২৮ নভেম্বরের ওই আদেশপত্রে সিভিল সার্জনের নাম লেখা ‘শফিউল’। এবার জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ এ কর্মকর্তাকে ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ থেকে আদেশপত্রের ছবি পাঠানো হলে সইটি জাল ও তার নামটিও ভুল লেখা আছে বলে নিশ্চিত করেন।

সিভিল সার্জন শফিউল আজম বলেন, ‘সঞ্জয় নামে কাউকে আমি চিনি না। এছাড়া সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে পদায়নের ক্ষমতা আমার নেই। আদেশপত্রটি পুরোপুরি ভুয়া। তিনি একজন জালিয়াত ও প্রতারক। এ বিষয়ে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

এরপর সঞ্জয় নিজেকে চিকিৎসক প্রমাণে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ ও ইনস্টিটিউটের সনদপত্রের ফটোকপি বের করেন। এখানেও জালিয়াতি ধরা পড়ে যায়। ওই সনদপত্রে তার নাম লেখা আছে ‘সঞ্জয় চন্দ্র শীল’। অথচ ফণিরমোড়ে তিনি নিজেকে ‘সঞ্জয় চন্দ্র দেব’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছেন। সনদপত্র অনুযায়ী সঞ্জয়ের মেডিকেল ডিপ্লোমা শেষ হয়েছে ২০২১ সালে। অথচ তিনি ২০১৯ সাল থেকে রংপুরের মিঠাপুকুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন বলে দাবি করেন।

jagonews24

সনদপত্রের সঙ্গে নামের মিল না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আদালতে এফিডেফিট করে নাম পরিবর্তন করেছি। তবে এ সংক্রান্ত নথি দেখতে চাইলে তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।

প্রতিবেদক সেখান থেকে চলে আসার সময় সঞ্জয় মানিবাগ থেকে টাকা বের করে ম্যানেজের চেষ্টা করেন। এমনকি চাহিদামতো আরও টাকা দেওয়ার আশ্বাস দেন।

ফণিরমোড়ের স্থানীয় বাসিন্দা রাজু আহম্মেদ বলেন, ‘দুই সপ্তাহ আগে বোনের জ্বর জ্বর ভাব নিয়ে চিকিৎসার জন্য সঞ্জয়ের কাছে গিয়েছিলাম। কোনো কিছু পরীক্ষা না করেই ইনজেকশন দিয়ে এক হাজার ৬০০ টাকা নেন। এরপর জানান, আর কোনো ওষুধের প্রয়োজন নেই। তিন দিন পরে বোন আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে শহরে নিয়ে যাই। উনি আসলে কসাই ডাক্তার।’

এ বিষয়ে বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইহান ওলিউল্লাহ জানান, সঞ্জয় নামের এক ব্যক্তি ভুয়া চিকিৎসক সেজে প্রতারণা করে আসছেন।স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। তাকে খোঁজা হচ্ছে। দ্রুতই আটক করে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এসআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।